দেশে গড়ে ওঠা সুতা-কাপড়ের মিলের দিকে সরকারের বিন্দুমাত্র নজর নেই। মাত্র ৫-১০ কোটি টাকা খরচ করে যারা গার্মেন্টস নামে ‘দর্জির দোকান’ খুলে বসেছেন তাদের জন্য সুবিধার সব দুয়ার খোলা। কিন্তু হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যারা সুতা-কাপড়ের মিল স্থাপন করেছেন তাদের জন্য সরকার কিছুই করছে না। অথচ তৈরি পোশাক খাতের শিল্পে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বাড়াতে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাৎপদ এ দুটি শিল্পকে শক্তিশালী করার কোনো বিকল্প নেই।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতসহ প্রতিযোগী দেশগুলো সুতা-কাপড়ের শিল্পে অলআউট সাপোর্ট দিয়ে বিশ্বে বড় বাজারের সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে। সেখানে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। সরকার শুধু ব্যস্ত ‘দর্জিগিরি’ নিয়ে। অথচ দর্জিগিরি ছাড়া এই সেক্টরের প্রায় সবকিছু আমদানি করতে হয়। কিন্তু রফতানি আয় থেকে আমদানি ব্যয় বাদ দেয়া হয় না।
ভুক্তভোগীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, কাপড় ও সুতার মিল স্থাপন করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের নানা প্রতিকূলতার মাঝে ব্যবসা করতে হচ্ছে। মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ শিল্পের কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। শুধু মাটি-পানি আর শ্রম ছাড়া নিজেদের কিছুই নেই। এত প্রতিকূলতার পরও দেশে টেক্সটাইল শিল্প গড়ে উঠেছে উদ্যোক্তাদের অসীম সাহস আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। কিন্তু ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদ, জ্বালানির অস্বাভাবিক মূল্য ও বন্দরের চার্জ বেশি হওয়ার কারণে এখন ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
বাজার প্রতিযোগিতায় যেখানে অবস্থান শক্তিশালী করতে চীন ও ভারত বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, সেখানে দেশে গড়ে ওঠা বস্ত্রশিল্প প্রয়োজনীয় নীতি-সহায়তার অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। তারা মনে করেন, বিশ্ববাজারে শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সুতা-কাপড়ের মতো ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে সহায়তা দেয়া সময়ের দাবি। এতে একদিকে অর্থনীতিতে নতুন বিনিয়োগ বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বাড়বে।
বিশ্লেষকদের কয়েকজন বলেন, মূলত ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে তুলতে না পারলে ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে। কারণ বিদেশি ক্রেতারা এখন লিড টাইমকে গুরুত্ব দেন, কম সময়ে পণ্য ডেলিভারি চান। তাদের মতে, সরকারের নীতিনির্ধারক মহল দেশে অর্থনীতি ও বেকারত্বের চাপ কমাতে চাইলে এই সেক্টরকে অবশ্যই অগ্রাধিকার দিয়ে শক্তিশালী করতে হবে।
এক্ষেত্রে তৈরি পোশাকের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হিসেবে কাপড় ও সুতার মিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে। এছাড়া এই সংকট নিয়ে শুধু ভুক্তভোগী শিল্প উদ্যোক্তারা ভাবলে হবে না, সরকারের নীতিনির্ধারক মহল থেকে শুরু করে আমলাতন্ত্রকেও অর্থবহ ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ওভেন খাতে ৬০-৭০ শতাংশ ও সোয়েটারে ৮০-৮৫ শতাংশ কাপড় বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। দেশীয় শিল্পের স্বার্থে সরকারকে নেতিবাচক এ পথ বন্ধ করতে হবে। বিপরীতে গার্মেন্টগুলো যাতে দেশীয় বস্ত্রকল থেকে কাপড় কেনে সেজন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানসহ কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
সামগ্রিকভাবে সুতা ও কাপড়ের মিলের উন্নয়নে সরকারকে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করতে হবে। যার কাজ হবে- বন্ডের অপব্যবহার রোধ এবং টেক্সটাইল খাতে উন্নয়ন রোডম্যাপ প্রণয়ন করা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, সুতা ও টেক্সটাইল শিল্পে প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি সরকার ভেবে দেখবে। এ খাতে কোনো প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে না। নতুন বছরে বিষয়টি ভেবে দেখব। দর্জি দোকানের মতো স্থাপন করা তৈরি পোশাক শিল্পে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। অথচ হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে যারা সুতা শিল্প ও টেক্সটাইল শিল্প গড়ে তুলেছেন তাদের কোনো সুবিধা দেয়া হচ্ছে না, এমন বাস্তব অবস্থা তুলে ধরা হলে মন্ত্রী বলেন, এখন তৈরি পোশাক শিল্পকে প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও তৈরি পোশাক শিল্পের অবস্থা ভালো নয়। এটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এজন্য টেক্সটাইল ও সুতা শিল্পে প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এছাড়া বন্ডের সুবিধা নিয়ে যারা আমদানিকৃত সুতা খোলাবাজারে বিক্রি করছে তাদের বিরুদ্ধে আরও শক্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে সূত্র জানায়, রফতানি আয়ের তথ্যে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। প্রতি বছর রফতানি আয়ের যে তথ্য দেখানো হয় তা পুরোপুরি সঠিক নয়। ওভেন গার্মেন্টস রফতানির বড় অংশ ফ্যাব্রিক্স আমদানিতে ব্যয় হয়। সেই অঙ্ক রফতানি আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করা হয় না। সরকার রফতানি আয়ের ভুয়া তথ্যে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। গার্মেন্টস মালিকরা রফতানি আদেশ পাওয়ার পর ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির মাধ্যমে ভারত-চীন থেকে ফ্যাব্রিক্স আমদানি করে। এই কাপড় দেশে এনে শুধু সেলাই করে পুনরায় রফতানি করা হয়। এক্ষেত্রে মোট রফতানির প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ মাত্র ৩০ ভাগ অর্থ দেশে আসছে। এছাড়া রফতানিমুখী সেক্টর হিসেবে গার্মেন্ট মালিকদের অনেকে কাঁচামাল আমদানির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইডিএফ সুবিধায় কম সুদে ঋণ সুবিধাও পেয়ে থাকে। কিন্তু তাদের আমদানিকৃত কাঁচামালের একটি বড় অংশ যখন খোলাবাজারে বিক্রি হয়, তখন সরকার এবং দেশীয় বস্ত্রশিল্প চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এভাবে দীর্ঘদিন থেকে গার্মেন্ট ব্যবসার সাইনবোর্ড লাগিয়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালীদের অনেকে এভাবে চোরাকারবারি করে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেছে।
অথচ দেশে উৎপাদিত উন্নত মানের সুতা ও কাপড় সেভাবে বিক্রি হচ্ছে না। তাদের চীন ও ভারতের সঙ্গে অসম এক প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। শুধু পশ্চাৎপদ শিল্প যেমন স্পিনিং ও টেক্সটাইল শিল্পের উন্নয়নের মাধ্যমে রফতানিতে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হলেও সেদিকে সরকারের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। এ খাতের উন্নয়নে নেই কোনো রোডম্যাপ।
এ অবস্থায় দেশীয় সুতা ও কাপড়ের বস্ত্রশিল্প এখন প্রায় ধ্বংসের পথে। বন্ড সুবিধায় আনা বিদেশি সুতা-কাপড়ের কালোবাজারি বন্ধ না হওয়ায় স্থানীয় মিলের উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায়। ছোট-বড় চার শতাধিক স্পিনিং মিলে অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে আছে ৮ লাখ টনের বেশি সুতা। কাপড়ের মিলগুলোর অবস্থাও একই রকম। এ কারণে বেশির ভাগ মিল মালিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছেন না। অনেকে খেলাপি হতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সব জেনেও সরকারের দায়িত্বশীল মহল নীরব ভূমিকা পালন করছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকার শুধু গার্মেন্ট নামের দর্জিগিরি নিয়ে ব্যস্ত। অথচ সরকারের উচিত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সঠিক নীতি প্রণয়ন ও প্রণোদনা দেয়া। তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের মধ্যে নানা বৈষম্য রয়েছে। এগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। উদাহরণস্বরূপ পোশাক শিল্পের কর্পোরেট কর সাড়ে ১২ শতাংশ। পক্ষান্তরে টেক্সটাইল শিল্পের ১৫ শতাংশ এবং এক্সেসরিজ শিল্পের ৩৫ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে আরও বৈষম্য রয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস এক্সেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএপিএমইএ) সভাপতি আবদুল কাদের খান বলেন, এক্সেসরিজ শিল্প বৈষম্যের শিকার। তৈরি পোশাক শিল্পের চেয়ে এক্সেসরিজ শিল্পকে ট্যাক্স বেশি দিতে হয়। অন্যদিকে নতুন বাজেটে পোশাক শিল্পকে ১ শতাংশ অতিরিক্ত প্রণোদনা দেয়া হলেও এক্সেসরিজ শিল্প সেটি পাচ্ছে না। অথচ দুই শিল্পেরই শ্রমিকদের বেতন ও পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। উদ্যোক্তাদের মতে, সরকারের সহযোগিতা ছাড়া ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এজন্য উদ্যোক্তাদের প্রকৃতপক্ষে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণ দিতে হবে। পাশাপাশি ওভেন ফ্যাব্রিক্সে প্রযোজ্য হারে প্রণোদনা বাড়ানোসহ গার্মেন্টগুলোকে স্থানীয় কাপড় ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে। তাহলে এ খাতে বিনিয়োগ আরও বাড়বে এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক ও আইএফসি (ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন) থেকে কম সুদে ঋণ নিতে সরকার ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করতে পারে। পাশাপাশি ঘন ঘন পরিবর্তন না করে দীর্ঘমেয়াদি নীতি প্রণয়ন করে এই খাতে বিশেষ প্রণোদনা চালু করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সরকার নিট খাতে প্রণোদনা দেয়ায় এখন এই খাত কিছুটা এগিয়েছে। এজন্য ওভেন ফ্যাব্রিক্স উৎপাদনে প্রণোদনা দেয়া খুবই জরুরি। সরকার ৫-১০ বছরের জন্য ওভেন খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিলে বড় বড় অনেক শিল্প গড়ে উঠবে। এতে একদিকে কর্মসংস্থান বাড়বে, অন্যদিকে রফতানিতে মূল্য সংযোজনের পরিমাণও বাড়বে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে ওভেন খাতে রফতানি আয়ের বড় একটি অংশ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এ অর্থ দেশে রাখতে তৈরি পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে তুলতে সরকারকে আরও বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। সিনথেটিক ফাইবার, পলিয়েস্টার ফাইবার, ম্যানমেইড ফাইবার উৎপাদনে প্রণোদনা দিলে দেশীয় বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। তার আগে সরকারকে বন্ডের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। তা না হলে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন না। এজন্য এনবিআরকে আরও তৎপর হতে হবে।