২০১৯ সালের বিভিন্ন ঘটনায় পোশাক খাত ঘিরে ছিল নানা শঙ্কা। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানিপণ্যের এ খাত বর্তমানে দুর্দিন পার করছে। ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পুরো উদ্যমে কাজ করলেও কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এদেশের পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্য অর্জনে বেশ বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শুরু হওয়া শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনায় গত বছরের শুরুতেই পোশাক খাতের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখা দেয়। সেই আশঙ্কা সত্যি করেই বিদায়ী বছরে একদিকে যেমন একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে, তেমনি হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন; অন্যদিকে কমেছে রপ্তানি আয়। গত জুনে পোশাকশিল্পে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি থাকলেও পরের মাসগুলোতে লাগাতার নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে ঘুরেছে এ খাতের রপ্তানি আয়ের চাকা। তবে নানামুখী চ্যালেঞ্জের পরও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি এগিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছরের ব্যবধানে পোশাক রপ্তানি পৌনে ৩ গুণ বেড়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয়। যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয়। নতুন বাজারেও ভালো করছে।
বিভিন্ন তথ্যে দেখা গেছে, বিদায়ী বছরের শেষ সময় পর্যন্ত পোশাক রপ্তানিতে ভাটা ছিল। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের প্রথম দুই সপ্তাহেই বাংলাদেশ থেকে পোশাক রপ্তানি ৩ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক। ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানিতে সহসা ভালো খবর পাওয়ার আশা নেই। বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ভিয়েতনামের মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সই এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনা পণ্যের মূল্য হ্রাস পেয়েছে ব্যাপক। এছাড়াও তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে উঠে আসছে নতুন নতুন দেশ। তিনি বলেন, আমরা ইতোমধ্যে সরকারের কাছে কিছু নীতি সহায়তার কথা বলেছি। সরকার আমাদের উৎস কর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। তবে আমরা উৎস কর কমানোর সিদ্ধান্ত ২০১৮ থেকে কার্যকর করার অনুরোধ জানিয়েছি। সেইসঙ্গে ১ শতাংশ বিশেষ প্রণোদনা পাওয়ার শর্তগুলো তুলে দিতে এবং প্রণোদনার ওপর ধার্যকৃত কর প্রত্যাহারের জন্যও বিজিএমইএর তরফ থেকে সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে জানান রুবানা হক। ব্যবসাকে টেকসই করার জন্য একটি এক্সিট পলিসি দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মজুরি বৃদ্ধিতে শ্রমিক অসন্তোষ : ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। সেই মজুরি ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কয়েকটি গ্রেডে বেতন আশানুরূপ বৃদ্ধি না পাওয়ায় এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে ভাতা কমে যাওয়ায় পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। নতুন মজুরি কাঠামোর অসঙ্গতি দূরীকরণে আন্দোলনে নামেন পোশাকশ্রমিকরা। সেই আন্দোলন দমাতে গিয়ে শিল্পমালিকরা শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা করেন। ১১ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই করা হয়। বিষয়টি নিয়ে শুধু দেশেই না, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে যৌক্তিকহারে মজুরি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঘোষিত মজুরির ৭টি গ্রেডের মধ্যে চ‚ড়ান্ত সিদ্ধান্তে ৬টি গ্রেডেই বেতন বাড়ে। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি চ‚ড়ান্ত মজুরি ঘোষণার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়।
রানা প্লাজা ধস পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পোশাকশিল্পে ৬৯৩টি ট্রেড ইউনিয়ন হয়েছে। তবে শ্রমিকনেতাদের দাবি, অধিকাংশ ট্রেড ইউনিয়নই মালিকপক্ষের চাপের মুখে অকার্যকর। নতুন করে ট্রেড ইউনিয়নের নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হলেও নানা অজুহাতে তা বাতিল করা হচ্ছে।
রপ্তানিতে ধাক্কা : পোশাক খাতে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জ আসছে। শুরু হয়েছে মূল্যযুদ্ধ। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ ভিয়েতনাম ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জুলাই এবং নভেম্বর মাসের মধ্যে ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ রপ্তানি কমেছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায়। ২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) তৈরি পোশাক রপ্তানি গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৩ দশমিক ৬৩ শতাংশ কম। তৈরি পোশাকশিল্পে বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী ভিয়েতনাম ওই বছরের প্রথম ১০ মাসে পোশাক রপ্তানি করেছে ২৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।
বছরের পর বছর ধরে সরকারের নীতিসহায়তা ও প্রণোদনা, সস্তা শ্রম আর উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশের পোশাকশিল্প শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়েছে। সেই পোশাক খাতের ওপর হঠাৎ করেই যেন অশনি সঙ্কেত নেমে আসে বিদায়ী বছরে। দিন দিন রপ্তানি পড়ে যাওয়া, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, শ্রমিকদের চাকরি হারানোর পেছনে পোশাক সংশ্লিষ্টরা ৫টি কারণ খুঁজে বের করেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো- মার্কিন ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার শক্ত অবস্থান ধরে রাখা এবং প্রতিযোগী দেশগুলোতে পোশাক রপ্তানিকারকদের বিভিন্ন ধরনের নীতি সহায়তা বৃদ্ধি। পোশাক মালিকদের মতে, বছরের শুরুতেই শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়ানোর কারণে কারখানায় উৎপাদন খরচ অনেক বেড়েছে। এছাড়া দক্ষ শ্রমিকের অভাবেও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বন্ধ হচ্ছে কারখানা, চাকরি হারাচ্ছে শ্রমিক : বিদায়ী বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৬০টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। বিজিএমইএর সদস্য এসব কারখানায় কাজ করতেন ২৯ হাজার ৫৯৪ জন শ্রমিক, যারা চাকরিচ্যুত হয়েছেন।
জানা গেছে, দেশের শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ত্রুটি সংশোধনে ব্যর্থতায় ক্রয়াদেশ পাচ্ছে না অনেক কারখানা। পণ্যের কাক্সিক্ষত মূল্য না পাওয়ার কারণেও ক্রয়াদেশ নিতে পারছে না কেউ কেউ। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবসা থেকে সরে যেতে হচ্ছে এসব কারখানাকে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোরও অনেকে ব্যয় সংকোচনে উৎপাদন ইউনিট কমিয়ে আনছে। পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, সামগ্রিকভাবে কারখানাগুলোয় ক্রয়াদেশ অনেক কম। এখানে বৈশ্বিক চাহিদা কমার বিষয়টি যেমন আছে, একইভাবে আছে বড় কারখানাগুলোর সক্ষমতা বাড়ার বিষয়টিও। ক্রেতারা ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে সবসময় বড় কারখানাকেই অগ্রাধিকার দেয়। বড়রা মূল্য কমিয়েও ক্রয়াদেশ নিচ্ছে। এতে সমস্যায় পড়ছে অপেক্ষাকৃত কম সক্ষমতার কারখানাগুলো।