নারায়ণগঞ্জের নিট পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এবিসি। স্থানীয় উৎস থেকেই শতভাগ কাঁচামাল সংগ্রহ করে পোশাকপণ্যের এ কারখানা। বিদেশী উৎস থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির চাহিদা না থাকায় কারখানাটি কোনো বন্ড লাইসেন্স নেয়নি। তবে স্থানীয় উৎস থেকে পোশাক তৈরির কাঁচামাল কেনার জন্য কারখানাটি ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র সুবিধা চাইলে বন্ড লাইসেন্স ছাড়া তা দেয়া যাবে না বলে জানিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো।
এবিসির মতো বন্ড লাইসেন্স নেই এমন আরো বেশকিছু কারখানা সম্প্রতি ব্যাংকে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলতে গেলে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সাম্প্রতিক এ তত্পরতায় বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে যাচ্ছে বিপুলসংখ্যক নিট পোশাক কারখানা। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, সংগঠনটির সদস্যদের ৭০ শতাংশ বা প্রায় ৬০০ কারখানার বন্ড লাইসেন্স নেই।
নিট পোশাক রফতানিকারকদের এ রফতানি প্রতিকূলতা দূর করতে ৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়েছে বিকেএমইএ। চিঠির অনুলিপি দেয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনকে (বিটিএমএ)।
চিঠিতে বিকেএমইএ বলেছে, সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংক তাদের বন্ড লাইসেন্সবিহীন গ্রাহকদের রফতানি ঋণপত্রের বিপরীতে স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করছে। এর মাধ্যমে তারা বন্ড লাইসেন্স করতে বাধ্য করছে, যা জাতীয় চেতনার পরিপন্থী। কোনো মালপত্র আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক প্রদানের বিষয় সম্পৃক্ত থাকলেই কেবল বন্ড লাইসেন্স আবশ্যক, যা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা কাস্টমস বন্ড শাখার এখতিয়ারভুক্ত। স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত কাঁচামালের ক্ষেত্রে শুল্ক প্রযোজ্য নয়। তাই এক্ষেত্রে বন্ড লাইসেন্সের আবশ্যকতা নেই।
বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, বিকেএমইএর সদস্য বা নিটওয়্যার পণ্য রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত শতকরা ৬০ ভাগের অধিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা শতভাগ স্থানীয় কাঁচামাল ব্যবহারের মাধ্যমেই তাদের রফতানি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। তাদের মূল্য সংযোজনও শতভাগ। এ অবস্থায় ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলার ক্ষেত্রে বন্ড লাইসেন্স থাকার বাধ্যবাধকতা এখনো বহাল থাকার বিষয়টি পোশাক শিল্প খাতে স্থানীয়ভাবে কাঁচামাল ব্যবহারকে শুধু নিরুৎসাহিতই করবে না, এ দেশের পশ্চাত্সংযোগ শিল্পের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে ভূমিকা রাখবে; প্রকারান্তরে যা আমদানিকেই উৎসাহিত করবে।
গভর্নরকে পাঠানো চিঠিতে বিকেএমইএ জানিয়েছে, বর্তমানে নিটওয়্যারের মূল্য সংযোজন প্রায় ৮৫ শতাংশ। এ শিল্পের কাঁচামাল সুতা থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক দ্রব্যাদির সবকিছুই বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। বর্তমানে নিটওয়্যার পণ্য রফতানির জন্য কোনো কিছু আমদানি না করেও রফতানি করা সম্ভব, যা আশির দশকে ছিল একেবারেই অসম্ভব। আশির দশকে সম্পূর্ণ আমদানিনির্ভরতার কারণে পুনরায় রফতানির স্বার্থে শুল্কমুক্তভাবে আমদানির জন্য বন্ড লাইসেন্সের প্রবর্তন হয়েছিল।
বিকেএমইএর প্রতিনিধিরা বলছেন, যদিও ফরেন এক্সচেঞ্জ গাইডলাইন প্রণয়নের অনেক আগে থেকেই বন্ড লাইসেন্সের এ শর্ত ছিল। অথরাইজড ডিলার বা এডি লাইসেন্সধারী সব বাণিজ্যিক ব্যাংক অনেক বছর ধরে ওই ধারা আমলে না নিয়ে স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খোলার সুযোগ দিয়ে আসছিল এবং দেশের রফতানি বাণিজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে এখনো প্রায় সব বাণিজ্যিক ব্যাংকই সুযোগটি অব্যাহত রেখেছে। যদিও সম্প্রতি কোনো কোনো ব্যাংক ফরেন এক্সচেঞ্জ গাইডলাইনসের শর্ত বিবেচনায় নিয়ে বন্ড লাইসেন্স নেয়ার জন্য বাধ্য করছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নীতিমালা বা ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্টে (এফইআরএ) ‘ব্যাক টু ব্যাক ইম্পোর্ট এলসি’ খোলার ক্ষেত্রে বন্ড লাইসেন্সের আবশ্যকতা ২০১৪ সালে সংযুক্ত হয়েছিল, যা ২০১৮-তে আরো কঠোর করা হয়। যার সূত্র ধরে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংক তাদের বন্ড লাইসেন্সবিহীন গ্রাহকদের রফতানি ঋণপত্রের বিপরীতে স্থানীয় ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করছে।
বন্ড লাইসেন্স না থাকলে ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র খুলতে অপারগতার বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বিষয়টি নিয়ে খাতসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। আর যাচাই-বাছাই করেই বাণিজ্যিক ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিয়ম পরিপালনের কঠোরতার কারণ বলা সম্ভব হবে। তবে দেশ ও রফতানির স্বার্থে কোনো নিয়ম শিথিল করার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিনিধিরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ পলিসি বিভাগের নির্বাহী পরিচালক হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সবসময়ই ওপেন মাইন্ডেড, অলওয়েজ অ্যাকোমোডেটিভ। রফতানিকারকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দেশের স্বার্থ অক্ষুণ্ন রেখে যেকোনো নিয়ম সমন্বয় করার বিষয়ে কাজ করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।