Home Apparel ৩০ বছরে অবিশ্বাস্য উত্থান ভিয়েতনামের

৩০ বছরে অবিশ্বাস্য উত্থান ভিয়েতনামের

ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ের রাস্তা ধরে যেতে থাকলে অবাক হতে হয়। কী বিপুল প্রাণশক্তি নিয়ে চলছে সবকিছু। চারদিকে ব্যস্ততা। অসংখ্য দোকান, সেখানে চলছে ক্রেতা–বিক্রেতার দর-কষাকষি, রমরমা বিকিকিনি। বর্তমান এই ভিয়েতনামকে দেখে ৩০ বছর আগের দেশটিকে চেনা দায়। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র এই দেশটি কীভাবে গত ৩০ বছরে নিজেদের মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করেছে, তা যেন এক গল্প।

১৯৫৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সংঘটিত একটি দীর্ঘমেয়াদি সামরিক সংঘাতের নাম ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এটি দ্বিতীয় ইন্দোচীন যুদ্ধ নামেও পরিচিত। প্রায় ২০ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের প্রভাবে ভিয়েতনামের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ভেঙে পড়ে। বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র অর্থনীতির দেশ হয়ে পড়ে ভিয়েতনাম। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হাল ছিল করুণ। ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম একত্র হওয়ার পর উত্তর ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে তার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গোটা ভিয়েতনামের ওপর প্রয়োগ করে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৫ সালে দেশটির মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ ছিল ২৩১ ডলার। ২০১৮ সালে এসে যা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৫৬৬ ডলারে। ১৯৮৪ সালে দেশটির জিডিপির আকার ছিল মাত্র ১৮ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের। তবে ১৯৮৬ সালে এসে পাল্টাতে শুরু করে পরিস্থিতি। সে বছর সরকার (কমিউনিস্ট পার্টি অব ভিয়েতনাম) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়। ‘আইএমআই’ সংস্কার প্রকল্প প্রবর্তনের মাধ্যমে ভিয়েতনামকে ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’ হিসেবে পরিচালিত করে সরকার। এখন সেই ভিয়েতনাম বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলোর একটি। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে ৭ শতাংশ। বর্তমানে চীনের সঙ্গে প্রবৃদ্ধিতে টেক্কা দিচ্ছে তারা। দেশটির রপ্তানির পরিমাণই এখন তার মোট জিডিপির সমান। নাইকি ব্র্যান্ডের জুতা থেকে শুরু করে স্যামসাংয়ের স্মার্টফোন—সবকিছুর উৎপাদন কারখানা আছে এই আশিয়ানভুক্ত দেশটিতে।

কীভাবে অবিশ্বাস্য উন্নয়ন হলো ভিয়েতনামে?

বিশ্বব্যাংক ও ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ব্রুকিংসের মতে, ভিয়েতনামের উন্নয়নযাত্রায় তিনটি বিষয়ের অবদান রয়েছে। ধাপে ধাপে এগিয়েছে ভিয়েতনাম। প্রথমত, দেশটি নিজেদের আগ্রহের সঙ্গে মিল রেখে বাণিজ্য উদারীকরণ করেছে। দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রণ না করে এবং ব্যবসা শুরুর ব্যয় কমিয়ে অভ্যন্তরীণ সংস্কারের সঙ্গে ও বাহ্যিক উদারীকরণকে পরিপূরক করেছে দেশটি। সর্বশেষ, ভিয়েতনাম নিজেদের মানুষের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। গড়ে তুলেছে মজবুত ভিত্তির অবকাঠামো।

আসলেই গত ২০ বছরে অসংখ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করেছে ভিয়েতনাম। ১৯৯৫ সালে আসিয়ানভুক্ত হয় ভিয়েতনাম (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১০টি দেশের আঞ্চলিক জোট আসিয়ান)। ২০০০ সালে এসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করে তারা। ২০০৭ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) যোগ দেয় ভিয়েতনাম। চীন, ভারত, জাপান ও কোরিয়ার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রয়েছে দেশটির। এসব চুক্তির প্রভাবে আমদানি ও রপ্তানি দুই ক্ষেত্রেই ধীরে ধীরে কিছুটা শুল্কছাড় সুবিধা পেতে শুরু করে ভিয়েতনাম। মুক্ত অর্থনীতি তৈরির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সংস্কারও চালিয়ে যায় ভিয়েতনাম সরকার। ১৯৮৬ সালে বিদেশি বিনিয়োগ–সম্পর্কিত প্রথম আইন তৈরি করে দেশটি, ফলে বিদেশি সংস্থাগুলো ভিয়েতনামে প্রবেশের সুযোগ পায়। ২০১৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা সক্ষমতা প্রতিবেদনে ভিয়েতনামের অবস্থান উঠে আসে ৫৫–তে। ২০০৬ সালে যা ছিল ৭৭-এ। শুধু তা–ই নয়, বিশ্বব্যাংকের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস বা সহজে ব্যবসা করার সূচকে ব্যাপক উন্নতি করেছে দেশটি। ২০০৭ সালে এই সূচকে দেশটির অবস্থান ছিল ১০৪-এ। ১০ বছরের মধ্যে (২০১৭) দেশটির উঠে আসে ৬৮-তে।

গত ৩০ বছরে মানবসম্পদ উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে ভিয়েতনাম। দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার মুখোমুখি হয়ে বর্তমানে ভিয়েতনামের জনসংখ্যা সাড়ে ৯ কোটি। যার অর্ধেকই ৩৫ বছরের কম বয়সী। ১৯৮৬ সালে দেশটির জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি। বলা হয়, যত বেশি জনসংখ্যা, তত বেশি কর্মসংস্থানের চাহিদা। তবে ভিয়েতনাম অবকাঠামো খাতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করেছে। ফলে জনসংখ্যা কোনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি দেশটির জন্য। জনসাধারণের জন্য ইন্টারনেট সস্তা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটির দরজায় কড়া নাড়ছে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে আইটি অবকাঠামো স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং বাজারবান্ধব নীতির কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিদেশি বিনিয়োগ এবং উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হয়েছে ভিয়েতনাম। তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি ইলেকট্রনিকস পণ্য তৈরির বড় বড় কোম্পানিও ভিয়েতনামে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছে।

পোশাক খাতে ভিয়েতনামের উত্থান

ভিয়েতনামের তৈরি পোশাকশিল্পের ইতিহাস আজকের নয়। কয়েক শ বছর আগে থেকেই এ দেশের নারীরা রেশম দিয়ে কাপড় বুনতে জানতেন। চমৎকার সিল্ক কাপড় তৈরি করতেন তাঁরা। আভিজাত্যের ছোঁয়া ছিল সেসব কাপড়ে। ১৯৫৮ সালের দিকে উত্তর ভিয়েতনামে তৈরি পোশাকশিল্পের উত্থান ঘটে। দক্ষিণ ভিয়েতনামে ১৯৭০ সালে এই শিল্প বিকাশ লাভ করে। সে সময় থেকে ফরাসিরা ভিয়েতনামের বড় বড় শহরে কারখানা তৈরি করেন। সেই থেকে এখন পর্যন্ত ভিয়েতনামের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে তৈরি পোশাকশিল্প। বর্তমানে ৬ হাজারের বেশি তৈরি পোশাক কারখানা ও উৎপাদন প্রতিষ্ঠান রয়েছে দেশটিতে।

২০১৮ সালে বৈশ্বিক পোশাকবাজারে ভিয়েতনামের হিস্যা ছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ট্রেড স্ট্যাটিস্টিক্যাল রিভিউ-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গড় হিসাবে এক দশক ধরে রপ্তানি আয়ে দুই অঙ্কের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে যেসব দেশের, তার মধ্যে প্রথমে আছে ভিয়েতনাম। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০১৮ সালে ৩০ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি পোশাক রপ্তানি করেছে তারা, যা ২০১৭ সালের চেয়ে ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। তৈরি পোশাকে বিশ্বের পাঁচটি বৃহত্তম রপ্তানিকারকের একটি এখন ভিয়েতনাম। দেশটির সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভিয়েতনাম এ বছরের প্রথম ১০ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে ২ হাজার ৭৪০ কোটি ডলার আয় করেছে।

গত বছরের প্রথম ৯ মাসে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে যায় ভিয়েতনাম। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৬১০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক। তার মানে, ৯ মাসে বাংলাদেশের চেয়ে ভিয়েতনাম ৩২০ কোটি ডলারের পোশাক বেশি রপ্তানি করেছে। জাতীয় দৈনিক ভিয়েতনাম নিউজ-এর এক প্রতিবেদনে সম্প্রতি বলা হয়েছে, চলতি বছর কয়েকটি বাজারে জটিলতা থাকার পরও দেশটির পোশাক রপ্তানি ৪ হাজার কোটি ডলারের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাবে। রপ্তানির পাশাপাশি ভিয়েতনামের অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজারও ৯০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে।

শুধু তা–ই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি দিন দিন বাড়ছে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের আওতাধীন অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলসের (অটেক্সা) তথ্যমতে, ভিয়েতনাম ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ১ হাজার ৩৩৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশ রপ্তানি করেছে ৫৫১ কোটি ডলারের পোশাক, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ শতাংশ বেশি। 

তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভিয়েতনামের অন্যতম ঝুঁকি হলো, দেশটির বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব ব্র্যান্ড মালিকানা নেই। তারা বিদেশি ব্র্যান্ডের আউটসোর্সিং অংশীদার হিসেবে উৎপাদন করে। ভূরাজনৈতিক জটিলতা তৈরি হলে বিষয়টি অর্থনীতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ছাড়া ভিয়েতনাম পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, কাঁচামালের জন্য আমদানির ওপর অধিক নির্ভরশীল, যা কেবল তার লাভের মার্জিনকেই কমিয়ে দেয় না, বৈদেশিক ব্যয়ও বাড়িয়ে দেয়। অবশ্য কাঁচামালের উচ্চ ব্যয় কাটিয়ে উঠতে সরকার ইতিমধ্যে সমর্থন শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ শুরু করেছে। 

ডিজিটাল উন্নয়ন

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্ষুদ্র একটি কৃষিপ্রধান দেশ ছিল ভিয়েতনাম। যার আয়তন প্রায় ১ লাখ ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। ২০ বছর ধরে চলা যুদ্ধে ক্ষয়ে গিয়েছিল দেশটি। তবে এখন ভিয়েতনাম আর সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ নেই। দেশটির মাথাপিছু আয় এখন প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন ডলারের বেশি। জিডিপির প্রবৃদ্ধি এ বছর ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছে দেশটির সরকার। ছোট এই দেশটিই এখন প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক উন্নতি করেছে। ভিয়েতনামের বেসরকারি এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে ৬ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে ইন্টারনেট সেবার আওতায় আনা গেছে। ২০১৭ সালের চেয়ে যা ২৮ শতাংশ বেশি। দেশটিতে মোবাইল সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা ১৪ কোটি ৩৩ লাখ। অর্থাৎ প্রতি একজনে ১ দশমিক ৫টি মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন।

দেশটির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে দেশটির ডিজিটাল ইকোনমির বাজার ৩০০ কোটি ডলারের ছিল। ২০১৯ সালে এসে তা ৯০০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ তা ৩ হাজার বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে মনে করছে দেশটি। স্যামসাংয়ের মতো বড় বড় প্রযুক্তি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান তাদের কারখানা গড়ে তুলেছে ভিয়েতনামে। নিজেদের ডিজিটাল অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করছে তারা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here