নারায়ণগঞ্জের নিট পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এমবি নিটওয়্যার। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তৈরি পণ্যের জন্য দেশের স্থানীয় বাজার থেকে অ্যাকসেসরিজ বা অনুষঙ্গ পণ্য কিনে থাকে। এসব পণ্যের মধ্যে আছে সুইং থ্রেট, লবণ, সোডা, স্কচটেপ, গামটেপ। এ পণ্যগুলো সাধারণত তিন থেকে চার মাসের মজুদ থাকে। কিন্তু চীনে প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া করোনাভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে বিক্রেতারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছেন। পাশাপাশি পণ্যের দামও বাড়িয়েছেন তারা।
কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ শুধু এমবি নিটওয়্যারের না, নিট পোশাক রফতানিকারকদের মধ্যে অনেকেই এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সভায় কৃত্রিম সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির অভিযোগ সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিদের জানানো হয়। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে আরো আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় আমদানি-রফতানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরাসহ ছিলেন ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ীরা। নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে সভায় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। যার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে সভায়। সার্বিকভাবে এ ভাইরাসের প্রভাবে কাঁচামালের সংকট এবং এর ফলে অর্থনীতিতে এক থেকে দেড় মাসের ধাক্কা আসবে বলে মত প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
সভা সূত্রমতে, সভায় আলোচনা হয়েছে আদা-রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য নিয়ে। বলা হয়েছে, এবার ভারতে ব্যাপক হারে আদার ফলন হয়েছে। গত বছর জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে যে পরিমাণ আদা আমদানি হয়েছিল, এ বছর এখন পর্যন্ত গতবারের চেয়ে তিন গুণেরও বেশি আমদানি হয়েছে। গতবার ৭০০ টন আমদানি হলেও এবার হয়েছে ২ হাজার ৯০০ টনেরও বেশি। এর প্রভাবে বাজারে আদার দাম কমে গেছে বলে জানিয়েছেন আমদানিকারকরা। এ বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে গতবারের চেয়ে তিন গুণ রসুনও বেশি আমদানি হয়েছে। আগে চীন থেকে এলেও এখন ভারত ও অন্যান্য গন্তব্য থেকে রসুন আমদানি করা হচ্ছে। সার্বিক দিক বিবেচনায় ভোগ্যপণ্যের বাজারে কোনো সমস্যা নেই বলে উঠে এসেছে সভায়।
নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের শিল্প-কারখানায় উদ্ভূত সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে সভায়। বিশেষ করে রফতানিমুখী নিট পোশাক রফতানিকারকদের সমস্যার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। রফতানিমুখী কারখানাগুলো স্থানীয় বাজার থেকে যেসব কাঁচামাল কিনে থাকে, সেগুলোর দাম বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ তোলেন সংশ্লিষ্টরা।
ভাইরাসটির অজুহাত দেখিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ জানিয়ে সভায় বলা হয়, তিন-চার মাসের সমপরিমাণ কাঁচামালের মজুদ সবসময়ই থাকে। তার পরও স্থানীয় বাজারে কাঁচামাল বিক্রেতারা করোনার অজুহাত দেখিয়ে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।
নিট পোশাক রফতানিকারকরা জানিয়েছেন, পোশাক পণ্যের যে অনুষঙ্গগুলো স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হয়, যেমন সুইং থ্রেট, রঙ করার কাজে ব্যবহূত সোডা, লবণ। সবগুলো পণ্যেরই দাম বেড়েছে। এছাড়া প্লাস্টিক অনুষঙ্গ যেমন স্কচটেপ, গামটেপ, মবিলন টেপ যেগুলোর সবই চীন থেকে আমদানি করতে হয়, এসবেরও দাম বেড়ে গেছে। অর্থাৎ করোনার প্রভাবে দু-তিন মাস পর যে সমস্যা বা সংকট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তা এখনই শুরু হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে নিটপণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, সভায় সবার আলোচনা থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, এক থেকে দেড় মাসের একটা ধাক্কা আমাদের ওপর দিয়ে যাবে। আমদানি যেমন ব্যাহত হয়েছে, রফতানিও ব্যাহত হবে। অন্যদিকে ভোগ্যপণ্যের বাণিজ্যিক আমদানি যেগুলো ব্যাপক হারে হতো, সেগুলো এক দেড় মাসের ধাক্কায় আমদানি কমে যাবে। তখন জাতীয় রাজস্ব আহরণের ওপরই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ পণ্য আমদানি হলে কর-শুল্ক বাবদ রাজস্ব আহরণ হতো, এখানেও একটা ঘাটতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাচ্ছে।
সভায় আলোচনার মধ্যে আরো ছিল বন্দরে পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা। এ বিষয়ে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস এবং এয়ারপোর্ট দুই জায়গার কার্যক্রমে আরো তত্পরতার প্রয়োজন হবে। কারণ জাহাজীকরণে বিলম্ব হওয়া পণ্যগুলো আসতে শুরু করবে। এগুলোর ক্ষেত্রে যেন কোনো অজুহাতে কালক্ষেপণ না করা হয়, দ্রুত পণ্য খালাস করে দেয়া হয়। বাজারে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা যেন কিছুটা হলেও লাঘব হয়, সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
শুধু নিটপণ্য নয়, করোনার প্রভাব হিসেবে সংকট দেখছে ওভেন পোশাক রফতানিকারকরাও। দেশের পোশাক শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের বড় উৎস চীন। দেশে বস্ত্রশিল্পের আমদানি করা কাঁচামালের ৪৬ শতাংশই আসে চীন থেকে। কভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ায় দেশটি থেকে কাঁচামাল সরবরাহ ব্যবস্থা এখন প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সামনের দিনগুলোয় এ পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আশঙ্কা করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। পরিস্থিতি মোকাবেলায় দুর্যোগ সহায়তা তহবিলসহ ঋণ সুবিধা চাইছেন তারা।
জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চীন থেকে বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে শুধু টেক্সটাইল ফাইবার ও টেক্সটাইল আর্টিকেলস ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারের। কাঁচামালের প্রধান সরবরাহকারী দেশটির চলমান পরিস্থিতি বাংলাদেশের উৎপাদনমুখী শিল্পের বাণিজ্য ও ব্যবসাকে বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।