তাঁতিদের জন্য শুল্ক রেয়াত সুবিধায় আনা সুতা, রং ও রাসায়নিক কালোবাজারে বিক্রি হচ্ছে। অস্তিত্বহীন অনেক সমিতির নামে ফ্রি স্টাইলে সুতা আমদানি করা হচ্ছে। আবার তাঁতি সমিতির লাইসেন্স ব্যবহার করে তৃতীয়পক্ষ রেয়াত সুবিধায় সুতা আমদানি করে তা বিক্রি করছে। এ কারণে প্রকৃত তাঁতিদের ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। এসব দ্রব্য বিক্রিতে নরসিংদীর মাধবদী, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইলের বল্লা ও নারায়ণগঞ্জের সুতার আড়তে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এদিকে রেয়াত সুবিধায় আমদানি করা সুতার সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দেশীয় সুতার মিলগুলোয় সুতার স্তূপ জমছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) তাঁত বোর্ডকে চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। জানা যায়, স্বাধীনতার পর দেশে তাঁত শিল্পের ব্যাপক প্রসার লাভ করে। সে সময় তাঁত শিল্পের সুতা সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত স্পিনিং মিল ছিল না। দরিদ্র ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল তাঁতিদের বিটিএমএ’র পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতা সরবরাহ করা হতো, যা দিয়ে তাঁতিরা গামছা, লুঙ্গি ও তোশকের কাপড়সহ মোটা কাপড় বানাতেন। এরপর সরকার তাঁতিদের রক্ষায় প্রথমে শুল্কমুক্ত সুবিধায় এবং পরে ৫ শতাংশ রেয়াত শুল্কহারে সুতা, রং ও রাসায়নিক আমদানির অনুমতি দেয়। এ সুযোগে তাঁতি সমিতির নামে সিন্ডিকেট সুতা আমদানি শুরু করে। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, তাঁতি সমিতির নেতাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। তারা সুতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যদিও তাঁতের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু তাঁতিদের নাম ভাঙিয়ে দেদার সুতা, রাসায়নিক আমদানি করছেন তারা। এ ক্ষেত্রে শুল্ক ফাঁকি দিতে আমদানি করা সুতার দামও কম দেখানো হচ্ছে। একদিকে আমদানি পর্যায়ে শুল্ক ফাঁকি দেয়ার কারণে সরকার ন্যায্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে খোলাবাজারে বিক্রির কারণে সেখান থেকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে। অথচ গরিব অসহায় তাঁতিরা প্রকৃতপক্ষে সরকারি এসব সুবিধা পাচ্ছেন না। কাস্টমসের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে অনেক ক্ষেত্রে ৬০ ও ৮০ কাউন্টের মতো উচ্চ কাউন্টের সুতা মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা হচ্ছে। শতভাগ স্টেকচার্ড রঙিন সুতাকে নন-স্টেকচার্ড হিসেবে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে। এমনকি ভিসকস সুতাও আমদানি হয়েছে, যার সঙ্গে তাঁতের সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যান শাহ আলম যুগান্তরকে বলেন, তাঁতের সুতা খোলা বাজারে বিক্রির বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। কোনো সমিতির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তদন্তসাপেক্ষে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাঁত বোর্ডের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে ১ হাজার ৩৪২টি তাঁতি সমিতি আছে। এসব সমিতির আওতায় প্রায় ৬ লাখ ১০ হাজার তাঁতি রয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দিনে দিনে ব্যবসা হারিয়ে পূর্বপুরুষের তাঁত ব্যবসা ছেড়ে তাদের অনেকে অন্য ব্যবসার দিকে ঝুঁকছেন। ভুক্তভোগী সুতার মিল মালিকরা বলছেন, দেশে তাঁতির সংখ্যা ৭০ শতাংশ কমলেও রেয়াত সুবিধায় সুতা আমদানি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাঁতের সুতা এভাবে খোলাবাজারে বিক্রি করায় সরকার একদিকে যেমন বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় স্পিনিং মিলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে হুমকিতে পড়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। বর্তমানে যত তাঁতি দেশে রয়েছেন তাদের সুতার প্রয়োজন মেটানোর মতো স্পিনিং মিল দেশে গড়ে উঠেছে। এমনিতে স্পিনিং মিলগুলো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং ঋণে জর্জরিত। এই পরিস্থিতিতে তাঁতি সমিতির সুতার অপব্যবহার বন্ধ করতে না পারলে তাঁত রক্ষার নামে দেশের সুতার মিলগুলোকে ধ্বংস করে দেয়া হবে। তারা আরও বলেন, সরকার সাধারণ তাঁতিদের সুবিধা দিতে রেয়াত সুবিধা দিয়েছে। কিন্তু এই রেয়াত সুবিধা দিতে গিয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ এবং ১০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে না। তাঁতিদের সুবিধা দিতে চাইলে স্থানীয় মিলগুলো থেকে সুতা কিনতে প্রণোদনা দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, স্পিনিং মিলে ব্যাংক খাতের বিনিয়োগ রয়েছে। স্পিনিং মিলগুলো বন্ধ হয়ে গেলে ব্যাংক খাতেও ধস নামবে। এমনিতে চীনের করোনাভাইরাস পোশাক শিল্পের দুর্বলতার কথা জানান দিয়েছে। অনেক গার্মেন্টে কাপড়ের অভাবে উৎপাদন বন্ধ হওয়ার পথে। যদি তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প হিসেবে কাপড়ের মিলগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারত, তাহলে এই সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। আর গার্মেন্ট মালিকদের চীনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। এখন দেশের স্পিনিং মিলগুলোকে ধ্বংস করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে মিথ্যা ঘোষণায় কম মূল্যে সুতা আমদানি করছে। বন্ডের সুতাও খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। আবার তাঁতি সমিতির নামে আমদানি করা সুতাও খোলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। এই ত্রিমুখী চাপ মোকাবেলা করে শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাঁতিদের জন্য দেয়া রেয়াত সুবিধা ভোগ করে রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা রাতারাতি টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছেন। কিন্তু গরিব-অসহায় তাঁতিরা কিছুই পাচ্ছেন না। অর্থাৎ সরকারের মহৎ উদ্দেশ্য অসৎ কাজে লাগানো হচ্ছে। ভুক্তভোগী মিল মালিকরা বলছেন, দেশে সুতা আমদানির প্রয়োজনই নেই। বর্তমানে বড় বড় শিল্প গ্রুপ স্পিনিং খাতে বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ করেছে। এসব স্পিনিং মিলে সব ধরনের সুতাই উৎপাদন হয়। কিন্তু তারপরও রফতানি আয়ের অজুহাত দেখিয়ে এবং তাঁতিদের অসহায়ত্বের কথা বলে সুতা আমদানি করে স্পিনিং খাতকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকারকে সেক্টরের প্রকৃত চিত্র জানতে হবে। স্পিনিং মিলগুলো সম্পর্কে ধারণা নিতে হবে। যেসব সুতা বাংলাদেশে উৎপাদন হয়, তার আমদানি শতভাগ বন্ধ করে দেশীয় উৎস থেকে সুতা সংগ্রহ করতে গার্মেন্ট ও তাঁতিদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। শুধু তখনই সত্যিকার অর্থে দেশ শিল্পে সমৃদ্ধ এবং সব পক্ষই উপকৃত হবে। বিটিএমএর পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, বন্ড ও তাঁতের সুতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে দেশের স্পিনিং মিলগুলোকে। অনেক তাঁতি সমিতির অস্তিত্ব বাস্তবে না থাকলেও সেসব সমিতির নামে রেয়াত সুবিধায় সুতা আমদানি হচ্ছে। অনুসন্ধান করে নরসিংদীর মেহেরপাড়া ইউনিয়ন ১নং প্রাথমিক তাঁতি সমিতি, আমদিয়া ইউনিয়ন ২নং প্রাথমিক তাঁতি সমিতির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তিনি আরও বলেন, নরসিংদীর মাধবদীতে হাটের দিন তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা রেয়াত সুবিধায় আনা সমিতির সুতা পান না। বাজার থেকে সুতা কিনতে হয়। টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জের তাঁতিদেরও একই অবস্থা। এ ছাড়া তাঁতি সমিতির নামে ডেনিম কাপড়ের ব্যবহারের রাসায়নিক আনার প্রমাণও পাওয়া গেছে। এদিকে তাঁতের সুতা, রং ও রাসায়নিক বিক্রিতে উদ্বেগ জানিয়ে তাঁত বোর্ডকে চিঠি দেয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে বিটিএমএ। গত সোমবার বিটিএমএ’র একটি প্রতিনিধি দল তাঁত বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলোচনায় তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিটিএমএ’র পক্ষ থেকে ৭টি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- প্রকৃত তাঁতি ও তাঁতি সংগঠনের সঠিক তালিকা নির্ণয়ে ডাটাবেজ তৈরি করা। তাঁতি সংগঠনগুলোর প্রকৃত সুতার চাহিদা নিরূপণ করে আমদানি করা সুতা দিয়ে কী ধরনের কাপড় তৈরি হবে, তার বিস্তারিত বিবরণ, সংশ্লিষ্ট তাঁতির নাম এবং তার কাপড় উৎপাদনের সক্ষমতা আছে কি না, তা যাচাই করা। আমদানি করা সুতা দিয়ে কী ধরনের কাপড় তৈরি হবে, আমদানির আগে সেই ঘোষণা দেয়ার ব্যবস্থা করা। প্রয়োজনে বিটিএমএ ও তাঁত বোর্ড থেকে সুতার প্রকৃত ব্যবহার সত্যায়িত করার বিধান চালু করতে হবে। তাঁতি বা তাঁতের সংগঠন বার্ষিক সুতা আমদানির সঠিক তথ্য সংরক্ষণ ও আমদানি করা সুতা দ্বারা তৈরি কাপড়ের পরিমাণের তথ্য সংরক্ষণ করা। তাঁতের নামে যেসব কাউন্টের সুতার আমদানি হচ্ছে, সেই সুতা তাঁতে ব্যবহারযোগ্য কি না, তা যাচাই করা। তাঁত সংগঠনের নামে আমদানি করা সুতার কার্টনের গায়ে ‘নট ফর সেল’ উল্লেখ করে আমদানির ব্যবস্থা করা।