দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রবৃদ্ধি কমছেই। ডিসেম্বরে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও তা আশানুরূপ নয়। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে ছোট আকারের কারখানা। সবচেয়ে বেশি শ্রমিকবান্ধব এ খাত থেকে এখন প্রতিনিয়ত কাজ হারাচ্ছেন শ্রমিকরা। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, চাহিদা কমে যাওয়া ও পোশাকের দাম না বাড়ার কারণেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বছরজুড়েই এমন পরিস্থিতি থাকবে বলে আশঙ্কা তাদের।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করা, সরকারের ইনসেনটিভগুলো পুনর্গঠিত করা, স্বল্প মূল্যের পণ্য উৎপাদন কমানো, মধ্যম ও উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়া, নতুন প্রযুক্তি আনা, ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা, ওয়েসটেস কমানো- এ সাত বিষয় নিয়ে কাজ করলে প্রবৃদ্ধি ২ অঙ্কের ঘরে আনা সম্ভব।
বিদায়ী বছরের শুরুতে অনেক প্রতিশ্রুতি ছিল পোশাক খাতে। কিন্তু শেষটা প্রায় পুরোটাই ছিল আশাভঙ্গের। কারণ বছরের শেষে দেখা গেছে, পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় চাপের মুখে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। বছরের শুরুতে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে পুরো উদ্যমে কাজ করলেও কিছু অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা এ দেশের পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্য অর্জনে বেশ বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শ্রমিক অসন্তোষ পোশাক খাতের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। রপ্তানিও কমে অব্যাহতভাবে। তবে মৌসুমের কারণে গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা ইতিবাচক। কিন্তু এ অবস্থা বেশি দিনের জন্য স্থায়ী হবে না বলে আশঙ্কা করছেন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, বৈশ্বিক বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভিয়েতনামের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি সই এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীনা পণ্যের দাম কমেছে। এ ছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে উঠে আসছে নতুন নতুন দেশ। আমরা আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতার জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি- এমন মন্তব্য করে রুবানা হক বলেন, আমাদের পোশাকের দাম বাড়ছে। তবে ক্রয় আদেশ তো আসছে না। অথচ ক্রেতারা ঠিকই ক্রয় আদেশ দিচ্ছে। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো ডলারের বিপরীতে তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়নের সুযোগে কম দাম অফার করে সেসব নিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমরা উৎসে কর শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনাসহ সরকারের কাছ থেকে কিছু নীতি সহায়তা পেয়েছি। এখন ব্যবসাকে টেকসই করার জন্য আমাদের একটি এক্সিট পলিসিও দরকার।
এদিকে পোশাক খাতের এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে বলেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, গত ডিসেম্বর মাসের শেষে পোশাক খাতের রপ্তানি আয় কিছুটা ভালো হয়েছে। এখন দেখার বিষয়, আগামী মাসগুলোতে কেমন যায়। বৈশি^ক পর্যায়ে বাণিজ্য যুদ্ধের যে অনিশ্চয়তা, তার ওপরেও নির্ভর করছে পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি। তবে সামগ্রিকভাবে ২০২০ সালেও আশাব্যঞ্জক প্রবৃদ্ধি হবে না বলে মনে করেন তিনি। গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এমন পরিস্থিতিতে আমাদের উচিত হবে, একটু ঠাণ্ডা মাথায় দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করে কিছু উদ্যোগ নেয়া। যেমন- গার্মেন্টস খাতে একই ধরনের পণ্য উৎপাদন হয়। আমরা যদি পণ্যে নতুনত্ব আনতে পারি, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার করতে পারি, কটন পণ্যের স্থানে নন-কটন পণ্য যদি আনতে পারি- এসব জায়গায় আমাদের কাজ করার আছে। এ জন্য সরকারের দিক থেকে উদ্যোগ আছে। এসোসিয়েশনগুলোরও যৌথ উদ্যোগ নেয়া দরকার। সরকার এ ক্ষেত্রে এখন যে ইনসেনটিভগুলো দেয় সেগুলোকে পুনর্গঠিত করা দরকার।
ড. মোয়াজ্জেম বলেন, আগে যেমন ডাবল ডিজিট প্রবৃদ্ধি পাওয়া যেত, সেটা পেতে সময় লাগবে। এ সময়টাকে তারা যেন ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করে। তাড়াহুড়ো করে সরকারের কাছ থেকে একটা সুবিধা না নিয়ে বরং টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য যা প্রয়োজন তা যেন করে। প্রয়োজনের মধ্যে রয়েছে- স্বল্প মূল্যের পণ্য উৎপাদন কমানো, মধ্যম ও উচ্চমানের পণ্য উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়া, নতুন প্রযুক্তি আনা, ব্যবস্থাপনার উন্নতি করা, ওয়েসটেস কমানো ইত্যাদি। এ বিষয়গুলো নিয়ে পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা কাজ করে। সংগঠনের পক্ষ থেকে তারা যেন গার্মেন্টস মালিকদের এ বিষয়গুলোতে উদ্বুদ্ধ করে।
বাংলাদেশে এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সালাম মুর্শেদী বলেন, আমরাই গর্ব করে বলতে পারি, পোশাক খাতে আমরা একমাত্র কমপ্লায়েন্স দেশ। তবে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি মনে করি, পোশাক খাতের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো এর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা কমেছে। নতুন বাজার প্রণোদনাসহ যদিও সরকার আমাদের নানা সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে, এরপরও আমাদের ইউটিলিটি বিল বেড়েছে, আমাদের ন্যূনতম মজুরি বেড়েছে, আমদানি-রপ্তানির খরচ বেড়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগী দেশগুলো হয়তো নীতি-সহায়তাসহ অন্যান্য কিছু সুবিধা পাওয়ায় আমাদের চেয়ে কম দামে পণ্য তৈরি করতে পারছে। তাই আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকার এ খাতের প্রতি বেশি নজর দেবে বলে প্রত্যাশা সালাম মুর্শেদীর।