ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনাম। বাণিজ্য আরো বৃদ্ধিতে সম্প্রতি দেশটির সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) সই করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। অন্যদিকে জিএসপি সুবিধা রক্ষায় বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়িয়ে চলেছে ইইউ।
বাংলাদেশসহ তিনটি দেশকে এভরিথিং বাট আর্মস (ইবিএ) স্কিমের আওতায় দেয়া বাণিজ্য সুবিধা নিয়ে সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় কমিশন (ইসি), যেখানে জিএসপি রক্ষায় বাংলাদেশকে কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করা হয়েছে। এসব সুপারিশের মধ্যে আছে শ্রমসংঘ গঠনের বাধা, ট্রেড ইউনিয়নবিরোধী বৈষম্য ও হয়রানি দূর করা, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন পদ্ধতি সহজ করা, শ্রমিকদের চাকরিচ্যুতি ও গ্রেফতার না করা, পরিদর্শন সক্ষমতা বৃদ্ধি, শিশুশ্রম নিরসন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলোর যথাযথ তদন্ত।
‘রিপোর্ট অন ইইউ এনহ্যান্সড এনগেজমেন্ট উইথ থ্রি এভরিথিং বাট আর্মস বেনিফিশিয়ারি কান্ট্রিজ: বাংলাদেশ-কম্বোডিয়া অ্যান্ড মিয়ানমার’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি গত ১০ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ করেছে ইসি। প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে ইসির মূল উদ্বেগের একটি ছিল শ্রম আইন। প্রচলিত আইনকে আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে বাংলাদেশের ওপর চাপ বৃদ্ধি ও সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়েছে এতে। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশ এসব সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে জিএসপি প্রত্যাহারে ইইউ প্রস্তুত বলেও জানিয়েছে কমিশন।
জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কেএম আলী আজম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, তারা (ইইউ) আগেও একবার আমাদের ইবিএ সুবিধা প্রত্যাহার করার কথা বলেছে। তারা হয়তো সংলাপগুলো অব্যাহত রাখতে চায়। আমাদের সঙ্গে যে কয়টি সংলাপ হয়েছে, তার সবই ছিল ফলপ্রসূ। তাদের চাওয়া প্রতিটি বিষয়ে আমরা সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা দিয়েছি। অনেক কাজ আমরা করেছি। আমরা মনে করি, সব ভালোরই আরো সুযোগ থাকে ভালো করার। সেই ভালো আমরা করার পক্ষে আছি। বাংলাদেশ সঠিক পথে আছে। আমার বিশ্বাস, তারাও এটা বুঝতে চাইছে এবং বুঝতে পারবে। যেহেতু আমরা সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা দিয়েছি, তারা হয়তো চাইছে চাপে রেখে সময়মতো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করাতে। সার্বিকভাবে তারা খুশি।
জানা গেছে, ইবিএ স্কিমের আওতায় ইউরোপে পণ্য রফতানিতে বাংলাদেশ শুল্কমুক্ত যে সুবিধা পায়, তা ধরে রাখতে বেশকিছু কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এ কর্মপরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে ইইউর কাছে ন্যূনতম ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় বছর সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।
পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদারে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরে (ডিআইএফই) ১ হাজার ৫১৪টি পরিদর্শক পদ সৃষ্টির ঘোষণা রয়েছে। এটি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট সময়সীমা চেয়েছিল ইইউ। শুধু পরিদর্শক নিয়োগ নয়, বাংলাদেশে শ্রম ও মানবাধিকার সুরক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন ঘাটতি পূরণে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে সময়াবদ্ধ বাস্তবায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করতে সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়গুলো নিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
গত বছরের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ সফরে আসে ইবিএ পর্যবেক্ষকদের একটি দল। সফরের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, বাংলাদেশে প্রচলিত শ্রম আইনের সঙ্গে এ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সামঞ্জস্য বিধানে হালনাগাদ আইন সংস্কার পর্যালোচনা। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা জেনারালাইজড স্কিম অব প্রেফারেন্সেসের (জিএসপি) অধীনে আন্তর্জাতিক কনভেনশনের সঙ্গে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা। পর্যবেক্ষক দলটি ২১ অক্টোবর বাংলাদেশে অবস্থান করে। সফর শেষে গত ডিসেম্বরে তাদের পর্যবেক্ষণ বাংলাদেশকে জানায় ইইউ।
বাংলাদেশ সফরকালে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে মতবিনিময়ের পর শ্রম অধিকার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিচ্যুতি চিহ্নিত করেছে ইইউ প্রতিনিধি দলটি। ফলে বাংলাদেশে শ্রম অধিকার চর্চার শক্তিশালী মান নিশ্চিতে সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করে একটি চুক্তির দিকে অগ্রসর হওয়ার বিষয়ে মত দেয়া হয় ইইউ থেকে। সেই মত অনুসরণ করেই গত ২ জানুয়ারি চিহ্নিত বিচ্যুতি দূর করতে ন্যূনতম ছয় মাস থেকে সর্বোচ্চ ছয় বছরের সময়সীমা চেয়েছে বাংলাদেশ সরকার।
শ্রম অধিকারসংক্রান্ত যে বিষয়গুলোর জন্য সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা ইইউ থেকে চাওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সুপারিশ অনুযায়ী বাংলাদেশ শ্রম আইন, শ্রম বিধিমালা ও ইপিজেড শ্রম আইন সংশোধন। শিশুশ্রম নিরসন, শ্রমিকের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধ, ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন বাধা দূর করা, শ্রম বিরোধ ও মামলা জট কমানো, শ্রম অভিযোগ নিষ্পত্তির পদ্ধতি উন্নয়ন এবং পরিদর্শকের ঘাটতি দূর করা।
দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন শিল্প পোশাক খাত নিয়েই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ। কারণ এ খাতের শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন গঠনসহ শ্রম অধিকারচর্চার বিষয়গুলো বেশি আলোচিত। জানতে চাইলে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক জানান, প্রতিবেদনটি হতাশার বহিঃপ্রকাশ নয়। বরং প্রসঙ্গগুলোকে তাজা রাখতে চায় তারা, যেন মূলনীতিগুলো হারিয়ে না যায়। ইইউ তাদের চাপ অব্যাহত রাখতে চায়।
সরকারি ও বেসরকারি সূত্রগুলো বলছে, ২০১৭ সালের শেষভাগ থেকেই ইইউর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শ্রমসংক্রান্ত ইস্যুগুলো কমপ্লাই না করলে বাংলাদেশের জিএসপি থাকবে না। জিএসপি স্কিমের আওতায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা বাংলাদেশ নিচ্ছে। এ সুবিধার ফল সমাজের সবাই সমানভাবে পাচ্ছে কিনা, সে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে ইইউ সংসদে।
২০২৪ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হলে বাংলাদেশের জন্য ইবিএ সুবিধা থাকবে না। তখন বাংলাদেশকে জিএসপি প্লাসের মাধ্যমে বাণিজ্য সুবিধা আদায় করতে হবে। বর্তমানে জিএসপি প্লাসের শর্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ ওই সুবিধার জন্য এখনো উপযুক্ত নয়। বাংলাদেশকে অনুরোধ করতে হবে। একই সঙ্গে ইইউকেও বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধার আওতায় রাখতে শর্তে পরিবর্তন আনতে হবে।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ। মোট পোশাক রফতানির ৬২ শতাংশ হয় ইইউতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রফতানির পরিমাণ ছিল ২১ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার।
আর ইউরোপিয়ান কমিশনের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে ইবিএর আওতায় ইইউতে বাংলাদেশ ১৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ইউরোর পণ্য রফতানি করেছে। সুবিধার আওতায় বার্ষিক প্রায় ২ বিলিয়ন ইউরোর শুল্ক বাংলাদেশ বাঁচাতে পেরেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনের একটি অংশে উল্লেখ করা হয়েছে, যে দেশগুলো উদ্বেগের বিষয়গুলোকে বিবেচনায় নিতে অনিচ্ছুক তাদের বিষয়ে আরো নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া ও মিয়ানমারকে মৌলিক মানবাধিকার ও শ্রম অধিকার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণে চাপ দিয়ে যাচ্ছে ইইউ। এছাড়া কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যৌথ পদক্ষেপের ব্যর্থতার বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।