কভিড-নাইনটিন (করোনাভাইরাস) এর প্রভাবে চীন থেকে পণ্যবাহী জাহাজ আসা আশঙ্কা হারে হ্রাস পেয়েছে। এতে বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। স্বাভাবিক সময়ে প্রতি মাসে চট্টগ্রাম বন্দরে চীন থেকে সরাসরি ১৫টি জাহাজ এলেও চলতি মাসে এসেছে মাত্র দু’টি জাহাজ। কমেছে চীন থেকে কন্টেইনার আসার পরিমাণও। ঝুঁকি এড়াতে চীন থেকে আসা জাহাজগুলোকে যাত্রা শুরু থেকে ১৪ দিন অতিবাহিত না হলে বন্দরে প্রবেশের অনুমতি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ব্যবসায়ীদের মতে, ফেব্রুয়ারি মাসে পণ্য নিয়ে চীন থেকে যে দু’টি জাহাজ এসেছে সেগুলো মূলত ডিসেম্বর বা তার আগে ঋণপত্র খোলা হয়েছিলো। প্রথমে চীনা নববর্ষ ও পরে কভিড-নাইনটিন (করোনাভাইরাস) কারণে জানুয়ারি থেকে ঋণপত্র খোলা এক প্রকার বন্ধ। চীন থেকে গার্মেন্টেসের কাঁচামাল ছাড়াও চামড়াজাত পণ্য, ঢেউটিন, রড, সিরামিক তৈরির কাঁচামাল আমদানি করা হয়। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রেরও মালামাল আসে চীন থেকে। বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি শফিকুল আলমের মতে, দেশের ৮০ শতাশং বিদ্যুৎকেন্দ্র চীনের ওপর নির্ভরশীল। প্রায় সব চাইনিজ প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক এস এস আবু তৈয়ব বলেন, মার্চের পর থেকে দেশের ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ বাংলাদেশের প্রায় সব কাঁচামালই চীন থেকে আসে। চীনা বন্দর ছেড়ে আসা জাহাজগুলোকে কমপক্ষে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পর বন্দরের প্রধান জেটিতে প্রবেশের অনুমতি দেয়ার বিধান চালু করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। অন্যান্য জাহাজগুলোর ক্ষেত্রে বন্দরে প্রবেশের আগে নাবিক এবং ক্রুদের শারীরিক তথ্য বন্দরের কাছে জমা দিতে হবে শিপিং এজেন্টকে। ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালক খায়রুল আলম সুজন গণমাধ্যমকে বলেন, এটি একটি ভালো পদক্ষেপ। তবে আমাদের আমদানি বাণিজ্যে কোনও প্রভাব যেন না পরে তা খেয়াল রাখতে হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে বর্তমানে চীন থেকে আসা ৩টি জাহাজ রয়েছে। যাত্রাপথে তাদের ১০ দিন অতিক্রান্ত হলেও আরও চারদিন বহির্নোঙরে পর্যবেক্ষণে থাকবে বলে বন্দর সূত্রে জানা গেছে। সাময়িক সমস্যা হতে পারে, বড় ঝামেলা হবে না কভিড-নাইনটিনের প্রভাবে বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যে সাময়িক সমস্যা হতে পারে, তবে বড় কোনও ঝামেলা হবে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তার মন্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তার মন্তব্য, কোভিডের প্রভাবে দুই দেশের বাণিজ্যে তেমন কোনও সমস্যা হবে না। রোববার (১৬ ফেব্রুয়ারি) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে দুই দেশের কূটনীতিকদের মধ্যে বৈঠক শেষে তারা এ কথা বলেন। চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমদানি ও রফতানিতে কোভিডের প্রভাবে তেমন বড় কোনও ঝামেলা তৈরি হবে না। তবে সাময়িক একটু সমস্যা হতে পারে। এরই মধ্যে নববর্ষের ছুটি শেষ হয়েছে, চীনারা কাজে ফিরতে শুরু করেছে। সহজেই সবকিছু সামলানো যাবে। লি জিমিং বলেন, এখনই বিকল্প বাজার খোঁজার সময় হয়নি। চীন এখনও আগের মতোই বাণিজ্য খাতে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করতে পারবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, চীন অনেক আস্থাশীল ও তড়িৎকর্মা রাষ্ট্র। তাদের অনেক মেকানিজম ও বিকল্প পদ্ধতি জানা আছে। যে কারণে তারা খুব শক্তভাবে কভিডকে মোকাবেলা করছে। ঠিক তেমনি তারা বাণিজ্যের দিকটিও গুছিয়ে নিতে পারবে। কোভিডের প্রভাবে দুই দেশের বাণিজ্যে তেমন কোনও সমস্যা হবে না। কভিডের প্রভাবে আগামী পাঁচ থেকে ছয় মাস যদি চীন থেকে পণ্য সরবরাহ বন্ধ থাকে, তাহলে রফতানি খাতে ১২-১৫শ কোটি টাকার ক্ষতি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ অ্যান্ড প্যাকেজিং ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএপিএমইএ)। সংগঠনটির সভাপতি আবদুল কাদের খান গণমাধ্যমকে বলেন, চীন থেকে মোট অ্যাকসেসরিজের ৪০ বা ৫০ শতাংশ আমদানি করা হয়। তবে আমাদের যে চাহিদা রয়েছে, এত অল্প সময়ে কাছাকাছি দেশ ভারতসহ অন্য কেউ এই সাপোর্ট দিতে পারবে না। ২১ ফেব্রুয়ারি (শুক্রবার) যদি চীনের কারখানাগুলো খুলে যায়, তাহলে আমাদের চাহিদা পূরণে সময় লাগবে না। বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিসিসিআই) সভাপতি গাজী গোলাম মর্তুজা গণমাধ্যমকে জানান, কভিড-১৯ পরিস্থিতির প্রভাব বাণিজ্যে পড়বে না। কারণ চীন একটি বিশাল আয়তনের দেশ। মূলত হুবেই ও আশপাশের কয়েকটি প্রদেশে কভিড শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু পরিকল্পিত অর্থনীতি গড়ে তোলার অংশ হিসেবে চীন একেকটি প্রদেশ বা অঞ্চলে একেক ধরনের পণ্য উৎপাদন কেন্দ্র বা হাব গড়ে তুলেছে। ফলে চীনে সব রকম পণ্য উৎপাদনে কভিডের প্রভাব পড়ার কথা নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে— এমন প্রদেশগুলো সংক্রমণের বাইরে থাকায় চীন থেকে পণ্য আমদানিতে এখন পর্যন্ত বড় কোনও প্রভাব পড়ার কারণে নেই। গাজী গোলাম মর্তুজা বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ-চায়না চেম্বারের পক্ষ থেকে চীনের সামগ্রিক পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রয়েছে। ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজও (এফবিসিসিআই) এ বিষয়ে কাজ করছে। চীনের সঙ্গে যেসব খাতে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে, সেসব খাতের সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে ভূমিকা রাখছে।