করোনাভাইরাসের প্রভাব থেকে সরকার-ব্যবসায়ীসহ দেশের সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে শিক্ষা নিতেই হবে। তা নাহলে সংকট আরও ঘনীভূত হবে। বর্তমানে চীন থেকে কাপড় আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যে অনেক গার্মেন্টের উৎপাদনও বন্ধ হওয়ার পথে। অথচ সরকার সময়মতো উপযুক্ত নীতি গ্রহণ করলে আজকের এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হতো না। তাই শিল্পের স্বার্থে, বিশেষ করে কাপড় উৎপাদনে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার এখনই সময়। সবাইকে একসঙ্গে জেগে উঠতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে নীতি প্রণয়নে সবার আগে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। এজন্য কাপড়ের মিলকে স্বনির্ভর করতেই হবে। এই মিল এগিয়ে গেলে দেশের বিশাল গার্মেন্ট শিল্পও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। এটি যথাযথভাবে করতে পারলে ভবিষ্যতে কারও মুখাপেক্ষী হতে হবে না। এ জন্য পর্যায়ক্রমে তৈরি পোশাক খাতের কাপড়ের আমদানি কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাড়তে মিলগুলোকে সর্বাত্মক সহায়তা দিতে হবে। সময়ক্ষেপণ না করে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে কার্যকর রোডম্যাপ প্রস্তুত করা জরুরি। যেখানে এ মুহূর্তের জন্য স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করাসহ পরবর্তীতে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। যা সরকার ও ব্যবসায়ীদের মতৈক্যের ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে। বস্ত্র খাতের উন্নয়নে এই রোডম্যাপ বাস্তবায়নে শক্তিশালী মনিটরিং বডি গঠনও সময়ের দাবি। বস্ত্র সেক্টরের সংকট নিয়ে মঙ্গলবার যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদের ভূয়সী প্রশংসা করে কাপড়ের মিল মালিকরা এ মুহূর্তে সরকারের করণীয় সম্পর্কে মতামত জানাতে গিয়ে উল্লিখিত পরামর্শ দেন। বস্ত্র খাতের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরে রিপোর্ট করার জন্য অনেকে মুঠোফোনে প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানান। এই সেক্টরের বিভিন্ন সংগঠনের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বলেন, যুগান্তরের রিপোর্টটি আমলে নিয়ে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণে সদস্যদের শিগগির চিঠি দেয়া হবে। এরপর সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে সরকারের প্রয়োজনীয় দাবি জানানো হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পেছনে নিঃসন্দেহে বস্ত্র খাতের ব্যাপক অবদান রয়েছে। এই সেক্টর ঘিরে কমপক্ষে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তৈরি পোশাক খাত নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানের অবদান অনস্বীকার্য। এছাড়া এই শিল্পের সঙ্গে নানা রকম সামাজিক ও অথনৈতিক কানেকটিভিটির ব্যাপকতা লাভ করেছে। একটি সঙ্গে অন্যটির ব্যবসা জড়িত। যেখানে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করে সেখানে কেনাবেচার বিশাল বাজার গড়ে ওঠে। আজ একেবারে গ্রাম পর্যন্ত মানুষের জীবনযাপনে যে গুণগত পরিবর্তন এসেছে তার পেছনে রয়েছে শিল্প উদ্যোক্তাদের বিরাট ভূমিকা। ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে বেসরকারি খাত শুধু বেকার সমস্যার সমাধান করছে না, মানুষের জীবন মানোন্নয়নে অনন্য ভূমিকা রাখছে। তাই এসব সম্ভাবনাময় সেক্টর সংকটে পড়লে সমাজের বহু মানুষের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মানুষ বেকার হয়ে গেলে কেনাবেচা কমে যাওয়ার পাশাপাশি ব্যবসার কালেকশনও কমে যাবে। বিপরীতে উদ্যোক্তারা ব্যাংকের দায়দেনা পরিশোধ করতে পারবে না। এর ফলে বহু ব্যাংকও খেলাপি ঋণের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়বে। তারা বলেন, দেশের এ রকম হালচাল কেউই প্রত্যাশা করে না। সেজন্য আমরা মনে করছি, অতীতে ভুল যা হবার হয়েছে। এজন্য কে বেশি দায়ী সে হিসাব না কষে দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। এজন্য তৈরি পোশাক খাতের স্বার্থেই এর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে শিল্পটিকে শক্তিশালী অবস্থানে নিতে হবে। কেননা গার্মেন্ট শিল্পের কাপড়সহ এর বড় একটি অংশ আমদানি নির্ভর। এর ফলে আমাদের প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাতে হচ্ছে। তাই সময়ক্ষেপণ না করে দেশের কাপড়ের মিলগুলোকে এখনই প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দিয়ে একটি প্যাকেজ কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠন মিলে যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে একটি বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যেখানে প্রধান উদ্দেশ্য থাকবে প্রতি বছর গার্মেন্ট খাতে কাপড় আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমিয়ে আনা। এজন্য স্থানীয় কাপড়ের মিলগুলোকে কমপক্ষে ৭ বছর পর্যন্ত ১৫% শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া। এছাড়া এসব মিলের যেসব কাপড় রফতানি তালিকা থেকে বাদ পড়বে সেগুলো স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি ৩-৪% সুদে ঋণ দেয়া। এর ফলে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের ন্যায় দেশীয় মিলগুলো এক সময় বাজার প্রতিযোগিতার সব সক্ষমতায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হবে। পৃথিবীতে যেসব দেশ এখন পর্যন্ত এসব সেক্টরে সফলতা অর্জন করেছে তারা এভাবেই তাদের শিল্পকে প্রটেকশন দিয়েছে এবং এখনও দিয়ে যাচ্ছে। ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, এই ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে পারলে আগামী ৭ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ নির্ঘাত কাপড় ও গার্মেন্ট শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারবে। তখন আর আমদানি করা কাপড় দিয়ে গার্মেন্ট চালাতে হবে না। দেশের উৎপাদিত সব ক্যাটাগরির উন্নতমানের কাপড় দিয়ে আমাদের গার্মেন্ট শিল্প বীরদর্পে এগিয়ে যাবে। তথ্যমতে, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৩ কোটি ১২ লাখ ডলারের পণ্য রফতানির বিপরীতে আমদানি করা হয়েছে ১ হাজার ৩৮৫ কোটি ১১ লাখ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে বস্ত্র খাতের সুতা ও কাপড় আমদানি হয়েছে ৪৩০ কোটি ৫৭ লাখ ডলারের। আর মেশিনারি ও ইলেকট্রিক যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে ৩৬১ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। পোশাক তৈরির অধিকাংশ কাঁচামাল আনা হয় চীন থেকে। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, চীনের করোনাভাইরাস প্রকারান্তরে দেশের জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিষয়টিকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আমরা স্বনির্ভরতার পথে এগুতে পারব। কেননা, এই ক’দিনের ধাক্কায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা নিশ্চয় গার্মেন্ট সেক্টরের প্রকৃত শক্তি-সামর্থ্য সম্পর্কে কমবেশি অবগত হতে পেরেছে। কেননা, আমদানিনির্ভরতা যে কোনো দেশের জন্যই মঙ্গলজনক নয়, সেটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখনও যদি সরকারের ঘুম না ভাঙে তাহলে সামনে আরও ভয়াবহ সংকট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সরকারের উচিত হবে, এ ধরনের সংকট মোকাবিলার জন্য দেশের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পকে প্রণোদনা দিয়ে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে আসা। কোনো একটি গোষ্ঠীর জন্য নয়, সবার আগে দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ব্যবসা-বাণিজ্যের নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তারা বলেন, ভালো কোনো কাজে নেতৃত্ব দিতে খুব বেশি লোকের প্রয়োজন হয় না। বিশ্বে এমন ভূরি ভূরি উদাহরণ আছে। যেখানে ১-২ জন লোকের নেতৃত্বে একটি দেশ উন্নতির সকল রেটিংয়ে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। তাই সরকারের নীতিনির্ধারক মহলের সঙ্গে আমাদের ব্যবসায়ী নেতারা সেভাবে কার্যকর মিটিং করতে পারলে এই সংকট দূর করা কোনো কঠিন কাজ নয়। বিশেষ করে আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশকে স্বনির্ভর করার প্রশ্নে সব সময় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই আমাদের বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রীকে বিষয়টি যথাযথভাবে অবগত করতে পারলে তিনি দ্রুত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবেন। সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘বর্তমানে ব্যবসায়ী নেতাদের মধ্যে সবাই যে নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তা নয়। অনেকের মধ্যে রয়েছে অগাধ দেশপ্রেম। যারা দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করে যেতে চান। এই শ্রেণির যোগ্য নেতাদের কাছে বিশেষ দাবি থাকবে, তারা যেন এখনই সরকারের সঙ্গে বসে সঠিক করণীয় নির্ধারণে উদ্যোগ নেন।’ তাহলে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোকে নানা রকম বিতর্ক ও প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে না। উল্লেখ্য, ‘প্রসঙ্গ বস্ত্র খাত : আসল কাজটি করেনি কেউ- ভুল নীতির খেসারত দিচ্ছে রাষ্ট্র’ শিরোনামে মঙ্গলবার প্রধান শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়।