করোনাভাইরাসের ভয়াবহ বিরূপ প্রভাব ঠেকাতে সবাই গার্মেন্ট সেক্টর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও কেউ কাপড় ও সুতার মিল নিয়ে জোরেশোরে কিছু বলছেন না। অথচ সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে এ খাতে। একেকটি বড় বড় মিলের পেছনে চার থেকে পাঁচশ’ কোটি টাকার বিনিয়োগ।
এছাড়া গার্মেন্ট সেক্টরে কাঁচামালের আমদানি কমিয়ে শতভাগ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ প্রতিষ্ঠার জন্য বস্ত্র খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা ছিল। কিন্তু সে বিষয়ে কারও কোনো নজরই নেই। এখন প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনার অর্থ দিয়ে মহল বিশেষ শুধু গার্মেন্ট খাত সামাল দেয়ার কথা ভাবছেন।
যদি বাস্তবে তাই হয় এবং করোনা পরিস্থিতি বিলম্বিত হয়, তাহলে দেশের এ বৃহৎ সেক্টর একেবারে ধসে পড়বে। তাই সবার আগে টেক্সটাইল মিলের কথা সরকারকে বিবেচনায় নিতে হবে। যুগান্তরকে এমন দাবির কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রথমসারির কয়েকজন শিল্পোদ্যোক্তা।
তারা বলেন, ‘সংকট ঘনীভূত হওয়ায় এখন করোনাভাইরাসের কারণে কাপড় ও সুতার মিল বন্ধ রাখতে হলে যে বিপুল ক্ষতি হবে তা পুষিয়ে দিতে সরকারকে উদারহস্তে এগিয়ে আসতেই হবে। তা না হলে বেশির ভাগ মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারবে না। উদ্ভূত সে রকম পরিস্থিতিতে ক্ষতি আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন কাপড়ের মিল মালিকরা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বৃহস্পতিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, টেক্সটাইল খাত রফতানিমুখী শিল্প হিসেবে আমরাও সরকারি সহায়তা পাব। যেহেতু টেক্সটাইল খাতে অনেক বেশি বিনিয়োগ ও বিপুলসংখ্যক কর্মসংস্থান জড়িত, সে প্রেক্ষাপটে প্রণোদনা বিভাজনের ক্ষেত্রে টেক্সটাইল খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
এদিকে বস্ত্র খাতে বিনিয়োগকারীদের কয়েকজন ক্ষোভ প্রকাশ করে বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘দেখুন আমাদের গার্মেন্ট সেক্টর শুধু সেলাই কাজের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। যাদের বেশিরভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। অনেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাপড়সহ অন্যান্য কাঁচামাল এনে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। এতে করে দেশে মিল স্থাপনকারী কাপড়ের মিল মালিকদের আরও বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া হয়।
তাছাড়া একেকটি গার্মেন্ট কারখানা করতে বড়জোর ২০-৩০ কোটি টাকা লাগে। কিন্তু কাপড়ের মিলের জন্য নানা রকম ঝুঁকি নিয়ে বড় অংকের বিনিয়োগ করতে হয়। একেকটি মিলে হাজার হাজার শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি করে।
যাদের পেছনে প্রতি মাসে মোটা অংকের বেতন-ভাতা গুনতে হয়। এছাড়া বড় অংকের গ্যাস-বিদ্যুৎ বিলসহ নানা রকম ইউটিলিটি বিল তো আছেই। উপরন্তু, প্রতিটি মিলকে ব্যাংক ঋণের বড় বড় কিস্তিও পরিশোধ করতে হয়। তা সত্ত্বেও বস্ত্রখাত সুরক্ষায় সরকারের পক্ষ থেকে প্রত্যাশিত ব্যবস্থা করা হয়নি। সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত না নেয়ায় দেশের সম্ভাবনাময় বস্ত্র খাত এখন প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।
বিশেষ করে ওভেন সেক্টরকে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। যার দায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো কোনোভাবে এড়াতে পারে না। প্রয়োজন ছিল, পর্যায়ক্রমে গার্মেন্টের জন্য কাপড় আমদানি কমিয়ে দেশের অভ্যন্তরে স্বয়ংসম্পূর্ণ ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ গড়ে তোলা। এছাড়া প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানসহ মনিটরিং বডি গঠন করে সরকারকে আশু করণীয় নির্ধারণ করা।
কিন্তু এ যাবত কোনো সরকারই তা করেনি। তারা বলেন, সুতায় নেই আমদানি ঠেকানো প্রটেকশন। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ওভেনে দেয়া হচ্ছে না প্রণোদনা। এছাড়া গার্মেন্টগুলোকে দেশীয় কাপড় কেনার ক্ষেত্রে বেঁধে দেয়া হয়নি কোনো সিলিং।
শুধু এসব ভুল নীতির কারণে সুতা ও কাপড়ের মিলগুলো শুরু থেকে নানামুখী সংকট মোকাবেলা করে রীতিমতো হাফিয়ে উঠেছে। এখন করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে বড় ধরনের কাপড় সংকটে পড়েছে গার্মেন্ট সেক্টর। সময় থাকতে যদি কাপড়ের মিলগুলোকে প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হতো তাহলে আজকে চীনের কাপড়ের জন্য গার্মেন্টগুলোকে বসে থাকতে হতো না।
একজন বিশ্লেষক বলেন, গার্মেন্টস খাতের শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প দেশে গড়ে উঠলে এ কঠিন সময়ে ব্যবসায়ীদের এত চিন্তিত হতে হতো না। কিন্তু সেটি না থাকায় এখন উৎপাদনে যেতে পারছেন না অনেকে। যদিও করোনার প্রভাবে ইতোমধ্যে গার্মেন্ট সেক্টরের সব অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ব্যবসায়ী সংগঠনের একজন প্রথমসারির নেতা যুগান্তরকে বলেন, ‘মহল বিশেষ সরকারকে ভুল বোঝানোর কারণে দেশে ওভেন খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প (কাপড়ে মিল) গড়ে উঠছে না। যদি দেশে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে উঠত, তাহলে আমাদের চীনের কাছে ধরনা দিতে হতো না। দেশের টেক্সটাইল খাতই ওভেন কাপড়ের চাহিদা মেটাতে পারত। কিন্তু দেশের সুতা ও কাপড়ের মিলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার ছিল, তা ৩০ বছরে কোনো সরকারই নেয়নি।’