করোনার প্রথম ধাক্কা কিছুটা সামলে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে দেশের তৈরী পোশাক শিল্প খাত। নানামুখী তৎপরতায় ফিরে পেতে যাচ্ছে করোনার আঘাতে বাতিল হওয়া আন্তর্জাতিক ক্রয়াদেশ। বড় বড় কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যেই তাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি সরকারের ঘোষিত প্রণোদনার টাকা সরাসরি শ্রমিকদের অ্যাকাউন্টে জমা দেয়ার ঘোষণায় আশ্বস্ত হতে শুরু করেছেন এ শিল্পে কর্মরত চল্লিশ লক্ষাধিক শ্রমিকও। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালানোর ব্যাপারে সরকারও ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। যদিও বসে নেই সমালোচকরা। প্রণোদনার অর্থ ছাড়ের আগেই নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা চলছে উপকারভোগীদের নিয়ে। বরাবরের মতোই মালিকপক্ষের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে সমালোচকরা বলছেন, সরকারের আনুকূল্য পেতে এবং শ্রমিকদের স্বার্থের কথা বলে নিজেদের আখের গোছাতে তৎপর রয়েছেন প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা।
বিভিন্ন পর্যায়ের উদ্যোক্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, করোনার কারণে যেসব ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান তাদের অর্ডার বাতিল করেছিল তারা সে অবস্থান থেকে সরতে শুরু করেছে। বাংলাদেশী তৈরী পোশাকের সবচেয়ে বড় ক্রেতা সুইডেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম গত শনিবার তাদের মনোনীত কারখানায় ইতোমধ্যে যেসব পোশাক তৈরি হয়েছে সেসব নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। একই পথে হাঁটছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ড পিভিএইচ, স্পেনভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্স, যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস), ফ্রান্সভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান কিয়াবি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খুচরা বিক্রেতা ব্র্যান্ড টার্গেট। এরাই বাংলাদেশী পোশাকের অন্যতম শীর্ষ ক্রেতা। এইচঅ্যান্ডএম বাংলাদেশ থেকে বছরে ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করে থাকে। এমঅ্যান্ডএস নেয় ১০০ কোটি ডলারের। ইন্ডিটেক্সও ১০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি পোশাক নেয়। কিয়াবি নিয়ে থাকে ৫০ থেকে ৭০ কোটি ডলারের পোশাক। ফলে ক্রয়াদেশ বাতিল হওয়ার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিতে পারছেন বলে জানান উদ্যোক্তারা। যদিও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর পক্ষ থেকে এখনো এ সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো ঘোষণা আসেনি।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০১৮-১৯ অর্থবছর বাংলাদেশের পোশাকশিল্প মালিকরা তিন হাজার ৪১৩ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেন। বিজিএমইএর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, করোনাভাইরাসের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে এক হাজার ৪৮টি শিল্পকারখানার ৯১ কোটি পিস তৈরী পোশাকের অর্ডার বাতিল হয়েছে। এর আর্থিক মূল্য ২৮৭ কোটি ডলার তথা ২৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এসব কারখানার বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ২০ লাখ শ্রমিক। সমস্যার ভয়াবহতা বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সপ্তাহে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠনের ঘোষণা দেন। অর্থ মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে এ জন্য একটি গাইডলাইন দিয়ে নির্দেশনা জারি করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিভাবে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে তহবিলের অর্থ বিতরণ করবে, সেটি চূড়ান্ত করতে এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন গভর্নর ফজলে কবির।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা নির্দেশনা অনুযায়ী, গত তিন মাস ধরে বেতন-ভাতা পরিশোধকারী কারখানাকে সচল হিসেবে বিবেচনা করে কেবল শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাবে এ টাকা পরিশোধ করতে হবে। প্যাকেজের এ অর্থ ক্ষতিগ্রস্ত রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না। তহবিল প্যাকেজের অর্থ মালিকপক্ষ পাবেন ঋণ হিসেবে। এ জন্য শিল্প উদ্যোক্তাদের দুই শতাংশ হারে সুদ পরিশোধ করতে হবে। ঋণের এই অর্থ পরিশোধের জন্য সময় পাবেন দুই বছর। এর মধ্যে ঋণ গ্রহণের পর রেয়াতি সময় পাবেন ৬ মাস এবং বাকি ১৮ মাসে ১৮টি কিস্তিতে এই টাকা শোধ দিতে হবে।
এ দিকে ক্রয়াদেশ বাতিলের প্রেক্ষাপটকে জটিলভাবে উপস্থাপন করে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা আদায়ের মাধ্যমে নিজেদের লাভবান করার অভিযোগ উঠেছে বিজিএমইএ নেতাদের বিরুদ্ধে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা এ বিষয়ে কিছুটা নমনীয় স্বরে কথা বলছেন কিন্তু ঝড় উঠছে সামাজিক মাধ্যমে। এমন কথাও বলা হচ্ছে যে, যখন দুর্যোগ-দুর্বিপাক দেখা দেয় তখনই ভিক্ষার থালা নিয়ে সরকারের দ্বারস্থ হন এ খাতের উদ্যোক্তারা। আর সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পোশাক শিল্পমালিকদের শক্ত অবস্থান থাকায় বরাদ্দ পেতেও তাদের তেমন বেগ পেতে হয় না। যদিও হারানো ক্রয়াদেশ ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হকের জোর প্রচেষ্টাকেই বেশি গুরুত্ব দিতে চান এ খাতের উদ্যোক্তারা।
বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, করোনার কারণে ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক ৪১ ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে ই- মেইল করেন। তিনি ক্রেতাদের অনুরোধ করেন, ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত করবেন না। উৎপাদন চলতে দিন। জরুরি অবস্থায় আমরা বিলম্বিত পরিশোধব্যবস্থা মেনে নেবো। তবে বর্তমানে যে স্টকগুলো রয়েছে তা নিয়ে নিন, যাতে উৎপাদন চলে এবং কর্মীদের সময়মতো বেতন দিতে পারি আমরা। পরে বিজিএমইএ সভাপতি জার্মানির কেন্দ্রীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নবিষয়কমন্ত্রী গার্ড মুলারকে ই-মেইল করেন। এতে তিনি জার্মানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন তার দেশের ব্র্যান্ড ও ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত না করে। একই আহ্বান জানিয়ে রুবানা হক এক ভিডিওবার্তায় ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের এই সঙ্কটের সময় পোশাক শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াতে আহ্বান জানান। ক্রয়াদেশ স্থগিত বা বাতিল হওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য বিজিএমইএ সভাপতি আইএলওসহ সংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক সংস্থাকে কাজে লাগান বলে দাবি বিজিএমইএর।
এ দিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ঘোষণা দিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পকারখানা চালানো যাবে। যারা কারখানা চালাতে চান, তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালাবেন। গতকাল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সেনাবাহিনী প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের সাথে এক সভা শেষ সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ ঘোষণা দেন তিনি। শিল্পকারখানা বন্ধের সিদ্ধান্ত সরকার থেকে আসেনি বলেও দাবি করেন মন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, পোশাক কারখানার জন্য যে ৫ হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে, সেটা দান নয়। এ টাকা ২ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হয়েছে। সময়ের ব্যবধানে পরিশোধ করতে হবে। কিভাবে তা শ্রমিকদের কাছে দেয়া যায়, সেটা নিয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ দিকে সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশন দিয়ে শিল্পের কাঁচামাল ও সরকারি সংস্থার জিনিসপত্র খালাস করার নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। গত ২৪ মার্চ এনবিআরের আরেক নির্দেশনায় দেশের সব কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশন সীমিত পরিসরে খোলা রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তখন জরুরি নিত্যপণ্য, চিকিৎসা সামগ্রী ও সেবাসামগ্রী খালাসের কথা বলেছিল এনবিআর। নতুন প্রজ্ঞাপনে এসব পণ্যের পাশাপাশি শিল্পের কাঁচামাল ও সরকারি সংস্থার জিনিসপত্র অন্তর্ভুক্ত করা হলো। এসবের মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্প কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।