করোনাভাইরাস মহামারীর সুযোগ নিয়ে বিদেশি ক্রেতারা পণ্য হাতে পেয়ে মূল্য পরিশোধ না করে এখন ‘ডিসকাউন্টের’ দাবি তুললে শক্ত অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক।
ব্রিটিশ একটি পোশাক ব্র্যান্ডকে এ বিষয়ে চিঠি দেওয়ার পর একথা বলেছেন তিনি।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার পর একে একে ক্রয়াদেশ বাতিল, স্থগিতের পর এখন আগেই হাতে পাওয়া পোশাকেরও মূল্যহ্রাসের দাবি তোলা হচ্ছে। তৈরি পোশাকের ৮০ শতাংশের বেশি কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, সেখানে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যহ্রাস চাওয়া হচ্ছে।
এই মূল্যহ্রাসের দাবি তোলা অনৈতিক মন্তব্য করে রুবানা হক বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “হ্যাঁ, আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। ব্রিটিশ একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে (ইডিব্লউএম) আমরা এ ধরনের একটি চিঠি দিতে বাধ্য হয়েছি। শুধু তাদেরকে নয়, যারাই চুক্তি ভঙ্গ করে এভাবে অনৈতিক ডিসকাউন্টের দাবি করবে তাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে হবে।”
ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বিলয়নেয়ার ফিলিপ ডের এডিনবরা উলেন মিল (ইডব্লিউএম) গ্রুপকে গত ২১ মে চিঠি পাঠিয়েছে বিজিএমইএ। ২৫ মার্চের আগে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, তার পাওনা পরিশোধের জন্য শুক্রবার পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে টাকা না পেলে মামলা করার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।
“তারা কী ধরনের রেসপন্স করে সেটা দেখার অপেক্ষায় আছি। তাদের উত্তর পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেব,” বলেন বিজিএমইএ সভাপতি।
পোশাক রপ্তানিতে নিয়মমাফিক এলসি না খুলে কোম্পানির সঙ্গে কোম্পানির প্রতিনিধির চুক্তির ভিত্তিতে চলা আসা এই আন্তর্জাতিক কেনাকাটা টিকে আছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও বোঝাপড়ার ওপর। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর সঙ্কটের কথা বলে একের পর এক চুক্তি ভঙ্গ করে ক্রয়াদেশ বাতিল করছে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতারা।
বিজিএমইএর হিসাবে, মহামারী শুরুর পর থেকে বাংলাদেশের ১১৫০টি কারখানার তিন দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে ক্রেতারা। যেখানে এই খাতে বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণই ৩৩ থেকে ৩৪ বিলিয়ন ডলার।
কার্যাদেশ পাওয়ার পর পণ্য প্রস্তুত করে বিদেশি কোম্পানির এজেন্টদের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়েছে- এমন ক্ষেত্রে বিনিময় অর্থ পরিশোধ আটকে রাখা হয়েছে বলে পোশাক রপ্তানিকারকরা বলে আসছেন। এবারের ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য বিদেশি ক্রেতাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অর্থ হাতে না পেয়ে বাংলাদেশের একজন পোশাক মালিকের কান্নার দৃশ্য আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে।
ইডব্লিউএম ও এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “এই সময়ে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত। একে অন্যের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো উচিত। এতে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নত হবে এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক আরও জোরালো হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আপনিসহ (ইডব্লিউএম) কিছু ক্রেতা কোম্পানি কভিড-১৯ এর সুযোগ নিয়ে লেনদেন বন্ধ করে দিয়ে এখন অযৌক্তিক ডিসকাউন্ট দাবি করছে।
“এটা আমাদের সদস্যদের জন্য শুধু অসম্ভবই নয়, বরং স্থানীয় আইন ও আন্তর্জাতিক মানের পুরোপুরি পরিপন্থি। কেনাবেচার সব ধরনের নৈতিকতারও লংঘন।”
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের দুই সংগঠন বিজেএমইএ ও বিকেএমইএর বক্তব্য হচ্ছে:
# ২৫ মার্চের আগে হস্তান্তর করা সব পণ্যের জন্যই চুক্তিতে উল্লেখিত মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এই অর্থ অবশ্যই ২৯ মে এর আগেই পরিশোধ করতে হবে।
# ইতোমধ্যে যে কার্যাদেশগুলো দিয়ে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে ম্যানুফ্যাকচারার ও বায়ারের মধ্যে আগামী ৫ জুনের ভেতরে একটি বোঝাপড়া হতে হবে। সব ধরনের বোঝাপড়া হতে হবে দ্বিপাক্ষিক সিদ্ধান্তে, বায়ারের একক সিদ্ধান্তে নয়। অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে কম ডিসকাউন্টের জন্য ইডব্লিউিএম ও এর সহযোগীদের জন্য আইনি পদক্ষেপের ফলাফল বয়ে আনবে।
ওই চিঠির অনুলিপি লন্ডনে বাংলাদেশ হাই কমিশন, বেপজা কার্যালয়, বিডা, বাংলাদেশ ব্যাংকে দেওয়া হয়েছে। এসব কার্যালয়ের অনুমতি নিয়েই বাংলাদেশে একটি লিয়াঁজো অফিস খুলেছিল ইডব্লিউএম।
বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, কোভিড-১৯ মহামারী শুরুর পর বাংলাদেশের অন্তত আটটি কারখানার আট মিলিয়ন ডলারেরও বেশি মূল্যের ক্রয়াদেশ বাতিল করেছে ইডব্লিউএম। এর মধ্যে রয়েছে রিভার সাইড স্যুয়েটার, স্কাইলাইন অ্যাপারেল, সাউদার্ন ক্লথিং, সাউদার্ন ডিজাইনার্স ও স্টিচওয়েল ডিজাইন।
একটি পোশাক কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পণ্য হাতে পাওয়ার পর ইডব্লিউএম আমার কাছে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট চাচ্ছে। অথচ একটি পোশাক তৈরি করতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। তাহলে আমরা কেন এত বড় লোকসান গুণে তাদেরকে পণ্য দেব?
“ব্রিটিশ এই কোম্পানিটি পুরোনো বেনিয়া চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে। শুধু তারা নয়, অন্যান্য অনেক ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান ক্রেতা অনৈতিক ডিসকাউন্ট দাবি করছে, যা মোটেও সম্ভব নয়। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের সংস্কার কাজের সময় তারা যেভাবে নৈতিকতার কথা বলেছিল এখন কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তাদের সেই নৈতিকতার বুলি নিমেষেই ভুলে গেছে। তা না হলে কিনে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার পর সেই পণ্যের ডিসকাউন্ট কীভাবে দাবি করে?”
এ বিষয়ে ব্রিটিশ ওই কোম্পানির বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলোর কাঁচামাল আমদানি হয় এলসির মাধ্যমে। অপরদিকে রপ্তানির প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় গত প্রায় এক দশক ধরে এলসির পরিবর্তে প্রতিষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মাধ্যমে পাঠানো হয় পণ্য। এতে করে বিদেশি ক্রেতারা কোনো কারণে চুক্তি ভঙ্গ করলে সেক্ষেত্রে আইনি সুরক্ষার সুযোগ কমে যায়।
রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জহিরউদ্দিন মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিদেশি ক্রেতাদের অনৈতিকভাবে ক্রয়াদেশ বাতিলের বিরুদ্ধে বিজিএমইএ যে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে, তা অত্যন্ত ধন্যবাদ দেওয়ার যোগ্য। এখন অসাধু ক্রেতাদের বিরুদ্ধে একটা শক্ত অবস্থান নেওয়ার সময় হয়েছে। এমনকি এলসির মাধ্যমে যেন পোশাক রপ্তানি করা যায় রাষ্ট্রীয়ভাবে সেই পদ্ধতিটা বাধ্যতামূলক করলে আরও ভালো হত।”