বৈশ্বিক মহামারি মোকাবেলায় যুগান্তকারী এক সমাধান নিয়ে এসেছে বাংলাদেশ, তৈরি করেছে করোনাভাইরাস প্রতিরোধক এক বিশেষ কাপড়। শুধু করোনাভাইরাস নয়, যেকোনো ভাইরাস ওই কাপড়ে লাগলে মাত্র ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে ৯৯.৯ শতাংশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে করোনাভাইরাস প্রতিরোধক কাপড় উদ্ভাবনে নিজেদের ওই সাফল্যের কথা জানায় দেশের বস্ত্র খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়ের। রাজধানীর গুলশানে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অংশ নিয়ে ওই কাপড় ও এর রপ্তানি বাজার সম্পর্কে আরো অনেক তথ্য জানান প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ব্যবসা উন্নয়ন ও বিপণন বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা রশিদ আশরাফ খান জ্যেষ্ঠ ব্র্যান্ড ম্যানেজার অনল রায়হান।
ব্র্যান্ড ম্যানেজার রায়হান বলেন, ‘সারা বিশ্ব যখন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে, ঠিক সেই সময় তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ বাংলাদেশ করোনাভাইরাস প্রতিরোধক কাপড় তৈরি করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।’ মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে শামিল হওয়ার তাগিদ থেকেই দুই মাস ধরে নানা গবেষণা করে ভাইরাস প্রতিরোধক কাপড় তৈরির কথা জাবের অ্যান্ড জুবায়ের কর্তৃপক্ষের মাথায় আসে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠানের কারিগরি সহায়তায় বাস্তবায়ন করা হয় ভাইরাসরোধী কাপড় তৈরির সেই পরিকল্পনা।
প্রতিষ্ঠানের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, তাঁদের তৈরি এ কাপড় করোনাভাইরাসসহ যেকোনো ভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে। এই কাপড় তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে বিশেষ রাসায়নিক পদার্থ। ফলে ওই কাপড়ে কোনো ভাইরাসই টিকতে পারবে না। যদি কোনোভাবে ভাইরাস কাপড়ে লাগে, মাত্র ১২০ সেকেন্ডে ওই কাপড় ৯৯.৯ শতাংশ ভাইরাসমুক্ত হবে। মহামারির কারণে থমকে যাওয়া দেশের পোশাক খাত নতুন ধরনের এ কাপড় তৈরি ও রপ্তানির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে আবার ঘুরে দাঁড়াবে বলে ভীষণ আশাবাদী জাবের অ্যান্ড জুবায়ের কর্তৃপক্ষ।
এমন আশাবাদের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, বিশেষ কাপড়টি উদ্ভাবনের মাত্র এক মাসের মধ্যে ক্রয়াদেশ পেয়েছে দেশের বস্ত্র খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়ের। মধ্যপ্রাচ্যের ইউনাইটেড গ্রুপ ইতিমধ্যে ওই কাপড়ে তৈরি পাঁচ লাখ মাস্ক নেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। ওই কাপড় নিতে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছে আমেরিকা ও ইউরোপের ক্রেতারাও। আগামী এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে পশ্চিমা বাজারের জন্য ওই কাপড় উৎপাদনে যাওয়ার কথা জানিয়ে অনল রায়হান বলেন, ‘দেশের বাজারেও আমাদের নিজস্ব আউটলেট ব্লুজিন্সের মাধ্যমে প্যান্ট, শার্ট, মাস্ক, অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাপড় বিক্রি করা হবে।
দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও জাবের অ্যান্ড জুবায়ের কর্তৃপক্ষের আলোচনা চলছ। দেশের প্রয়োজনে ওই কাপড়ের কেবল উৎপাদন খরচ রেখে সামাজিক সুরক্ষায় অংশ নিতে চায় তারা। সাংবাদিকদের জন্য সৌজন্য হিসেবে কিছু ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
কাপড়ের ব্যবহার সম্পর্কে জাবের অ্যান্ড জুবায়ের জানায়, মেডিক্যাল গাউন, পিপিই, মাস্কসহ সাধারণ সব ধরনের পোশাক তৈরিতে ভাইরাস প্রতিরোধক ওই কাপড় ব্যবহার করা যাবে। তবে বিশেষায়িত কাপড় হওয়ায় সাধারণ কাপড়ের চেয়ে এর দাম গজপ্রতি ২০ শতাংশ বেশি হবে।
কাপড়ের মান সম্পর্কে কর্মকর্তারা জানান, এই কাপড় আমেরিকা-ইউরোপে বাজারজাত করার লক্ষ্যে অ্যান্টিভাইরাল কাপড়ের সনদ নেওয়া হয়েছে মান সনদকারী বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান ইউকে সার্টিফিকেশান অ্যান্ড ইন্সপেকশান লিমিটেড থেকে। বিশ্বের সেরা দুই প্রতিষ্ঠান থেকে কয়েক দফায় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এ সনদ অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।
আইএসও ১৮১৮৪ এর অধীনে কাপড়টি পরীক্ষা করা হয়েছে উল্লেখ করে অনল রায়হান আরো জানান, কাপড় তৈরির মূল উপাদানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিষাক্ত পদার্থ নিয়ন্ত্রণ আইন ও পরিবেশগত সুরক্ষা সংস্থায় নিবন্ধিত। ভাইরাস রোধে এ কাপড় প্রায় শতভাগ নিরাপত্তা দিলেও ২০ বার ধোয়ার পর এর কার্যকারিতা কিছুটা কমে আসবে।
বস্ত্র খাতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম এই কাপড় উদ্ভাবিত হয়েছে বটে, তবে অদূর ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোও এই কাপড় তৈরিতে এগিয়ে আসবে বলে আশাবাদী জাবের অ্যান্ড জুবায়ের।
জানতে চাইলে বস্ত্র খাতের প্রবীণ ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোশিয়েশনের (বিটিএমএ) পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, ‘বস্ত্র খাতে এমন কাপড় তৈরি করার ক্ষেত্রে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম। ফলে চীনের বাজারের প্রতি বিমুখ ক্রেতারা এখন বিকল্প এবং অপ্রচলিত পণ্যের বাজার হিসেবে বাংলাদেশকে অন্য চোখে দেখবে।’ তিনি জানান, ২০ শতাংশ ক্রেতা চীনের বাজার থেকে অন্য দেশে তাদের বিনিয়োগ স্থানান্তরিত করতে চায়। এর দুই থেকে তিন শতাংশ পেলেও বাংলাদেশের রপ্তানি বাজার নতুন করে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারে।
রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী বলেন, ‘দেশের বস্ত্র খাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠান জাবের অ্যান্ড জুবায়েরের এই উদ্যোগ বিশ্ববাজারে প্রশংসিত হবে। বাংলাদেশের ইনোভেশনে নতুন অধ্যায় সূচিত হলো। আমাদের উদ্যোক্তাদের নলেজ ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এক ধাপ এগিয়ে গেল।’