Home বাংলা নিউজ ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে পোশাক খাতে

ক্রয়াদেশ আসতে শুরু করেছে পোশাক খাতে

চীন থেকে শুরু হয়ে গত জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বেশির ভাগ পশ্চিমা দেশ অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিল। দেশগুলোর খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলোও ছিল বন্ধ। এর প্রভাবে বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতাদেশের কবলে পড়ে। আবার দেশের অভ্যন্তরে করোনা ঠেকাতে কারখানা বন্ধ রাখতে হয় প্রায় এক মাস। এ পরিস্থিতি কাটিয়ে গত ২৬ এপ্রিল থেকে কারখানা সচল হতে শুরু করেছে। কারখানা মালিকরা বলছেন, বাতিল বা স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশগুলোর কিছু ফিরে এসেছে। আবার নতুন ক্রয়াদেশও পেতে শুরু করেছে কারখানাগুলো। কিন্তু তা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয়কারী অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন,  আমরা অনেক অর্ডার প্লেস করছি। লকডাউন থেকে সচল হওয়ার পর আমাদের সব সরবরাহকারী নতুন ক্রয়াদেশ পেয়েছে।

ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় কেমন, এমন প্রশ্নের উত্তরে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ম্যানেজার বণিক বার্তাকে আরো বলেন, ভোক্তা আচরণে আমরা বড় ধরনের পরিবর্তন দেখছি। মানুষের অগ্রাধিকার বদলেছে। আমরা স্টোরগুলোতেও কম ভিড় দেখছি। অনলাইন বড় সফলতার ক্ষেত্র হলেও এক্ষেত্রে অনেক কাজ প্রক্রিয়াধীন। এদিকে লকডাউনে স্টোর বন্ধ থাকায় মজুদ পণ্য নিয়েও আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে আমরা পরিকল্পনা নিয়ে ব্যস্ত, অনেক কাজ প্রক্রিয়াধীন।

ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি নিয়ে পোশাক শিল্প মালিকের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, আজ পর্যন্ত পোশাকের বৈশ্বিক বিক্রির পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে পুনরুদ্ধারের কোনো ইঙ্গিত নেই। বিশ্বব্যাপী দেশগুলো অবরুদ্ধ বা লকডাউন পরিস্থিতি থেকে পুনরায় সচল হওয়া নিয়ে লড়াই করছে। কারণ কভিডের উল্লেখযোগ্য ঢেউ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে দমিয়ে রাখছে। এটা আমাদের জন্য খারাপ সতর্কবার্তা, কারণ পোশাক শিল্প পশ্চিমা বাজারের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল।

যুক্তরাষ্ট্রের পোশাকের খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলোর বিক্রি গত বছরের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিলে ৮৭ শতাংশ কমেছে। মে মাসে কমেছে ৬৩ দশমিক ৩৬ শতাংশ—এমন তথ্য

জানিয়ে বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা বলছেন, এ বছরের মার্চ থেকে আমাদের পোশাক রফতানিরও অবাধ পতন ঘটছে। মার্চে রফতানি কমেছে ২০ শতাংশ, এপ্রিলে ৮৫ শতাংশ, মে মাসে ৬৩ শতাংশ। জুনে অবস্থা তুলনামূলক ভালো হবে, কারণ আমরা আশা করছি পতনের হার কমে আসবে।

বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে কারখানাগুলোর গড় সক্ষমতার ৫৫ শতাংশের মতো ক্রয়াদেশ আছে, যা বছর শেষে বাড়তে পারে। ২০২০-এর ডিসেম্বরের মধ্যে সক্ষমতার ৭০ শতাংশ ক্রয়াদেশ হতে পারে। এ ধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবসম্মত নাও হতে পারে। তার পরও আমরা ২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে নিয়মিত রফতানির ৮০ শতাংশ হবে, এ আশা করতে পারি।

দেশের পোশাক খাতের অন্যতম বৃহৎ প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপ। প্রতিষ্ঠান সূত্র অনুযায়ী, তাদের ক্রয়াদেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গত বছরের তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কম। বর্তমান সক্ষমতা অনুযায়ী দিনে ১০ ঘণ্টা উৎপাদন সচল রাখলে স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কারখানায় প্রতি মাসে ৫২ লাখ পিস পোশাক তৈরি হয়। আগামী জুলাই মাসের জন্য ক্রয়াদেশ আছে ৪৫ লাখ পিসের। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশের প্রতিশ্রুতি আছে মাসে গড়ে ২৫ লাখ পিস করে।

স্ট্যান্ডার্ড সূত্র বলছে, সক্ষমতা ৫২ লাখ পিস ধরে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের জন্য নিশ্চিত ক্রয়াদেশের পূর্বাভাস থাকার কথা অন্তত ৫৫ লাখ পিসের। এ হিসেবে সেপ্টেম্বর থেকে ক্রয়াদেশের পূর্বাভাসই অর্ধেক কম, নিশ্চিত কতটুকু হবে এখনো বলা যাচ্ছে না। গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা বলে, স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত উৎপাদনের পিক সময়। ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে লকডাউনে কারখানা বন্ধ হলো। সেই সময়ে ৫০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। এর মধ্যে কিছু আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু সেগুলোর ডেলিভারি অনেক পিছিয়ে গেছে।

স্ট্যান্ডার্ড গ্রুপের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গোটা গার্মেন্টস খাতেই ভয়াবহ অবস্থা। ঈদ পর্যন্ত আমাদের কারখানাগুলো কোনোভাবে ৮ ঘণ্টা সচল রাখা সম্ভব হবে। ঈদের পর কী হবে বোঝা যাচ্ছে না। অনেক কারখানা আমাদের থেকে ঠিকা বা সাবকন্টাক্ট পদ্ধতিতে কাজ নিয়ে উৎপাদন করত, এখন আমাদেরই ক্রয়াদেশ নেই। নারায়ণগঞ্জে অনন্তের ক্রয়াদেশ কমে গেছে, হা-মীমে এই মাসে কিছু ক্রয়াদেশ ছিল, পরবর্তী অবস্থা জানি না। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জন্য এখন পর্যন্ত ভালো খবর নেই।

পোশাক শিল্পের প্রতিনিধিরা বলছেন, একটি নির্দিষ্ট কারখানা বিবেচনায় নিলে দেখতে হবে ওই কারখানা কোনো ক্রেতার কাজ করছে। যারা ওয়ালমার্টের মতো বিক্রয়কেন্দ্রভিত্তিক ক্রেতার সঙ্গে কাজ করছে তারা কিছু ক্রয়াদেশ করছে, কারণ ওই ধরনের বিক্রয়কেন্দ্রগুলোতে গ্রোসারি কেনাকাটার পাশাপাশি ভোক্তারা কিছু কিনছে। হয়তোবা তারা টি-শার্ট কিনছে কিন্তু শার্ট কিনছে না। আবার ডেনিম বিক্রি হচ্ছে বলে ক্রয়াদেশ থাকলেও ফরমাল ট্রাউজারের অর্ডার নেই, কারণ বিক্রি নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত মানুষ তার স্বাভাবিক চলাচলে বাইরে না বের হবে ততক্ষণ পর্যন্ত বিক্রি বাড়বে না, এমন তথ্য উল্লেখ করে শিল্প মালিকরা বলছেন, বিক্রি না হলে তো অর্ডার প্লেস হবে না।

যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, ইতালিতে পোশাক বিক্রির প্রধান অংশই হয় পর্যটকভিত্তিক। দেশগুলো এখন পর্যটকশূন্য, বিক্রি হবে কীভাবে? এমন প্রশ্ন তুলে পোশাক কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, একদিকে পর্যটক নেই, অন্যদিকে দেশগুলোর নিজস্ব ক্রেতারাও বাইরে বের হচ্ছে না। কিছু বিক্রয়কেন্দ্র চালু হলেও সেখানে কেউ যাচ্ছে না। আমাদের দেশে যারা বড় কারখানা তারা তো একটা পণ্যের ওপর ভিত্তি করে কারখানা পরিচালনা করে না। দেখা যায় একটি কারখানা শার্ট বানায়, টি-শার্ট বানায়, ট্রাউজার ও ব্লাউজ বানায়। এতগুলো পণ্যের হয়তো কোনোটির চাহিদা আছে, কোনোটির নেই। যেটার চাহিদা আছে সেটার ক্রয়াদেশ আছে।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন অর্ডার প্লেসমেন্টের অবস্থা আমি ভালো শুনিনি। সবাই খারাপ বলছে। কেউ বলে কিছু আছে, কেউ বলে নেই। বেশির ভাগ কারখানার কাছে শুনতে পাচ্ছি কারো সক্ষমতার ৫০ শতাংশ আছে, কারো আছে ৬০ শতাংশ। নিটের কিছু অর্ডার আছে। আমাদের কাস্টমার বলছে আরো মাস দুয়েক গেলে পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে। রিটেইল শপগুলো চালু হলেও লোক নেই। কোনো কারখানাই শতভাগ সক্ষমতা ব্যবহারে নেই। ক্রেতারা যারা বলছে ক্রয়াদেশ দিচ্ছে তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় কী পরিমাণ ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, তাহলে তারা আর কোনো উত্তর দেবে না। কারণ তারা এমনিতেই বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ ক্রয়াদেশ কম প্লেস করছে। অনেক কারখানায় কোনো অর্ডারই প্লেস করেনি। ক্রেতা যদি বলে অন্যদের তুলনায় আমি কিছু তো দিচ্ছি, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা।

সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে কারো পূর্ণ সক্ষমতায় চলার কাজ নেই – এমন তথ্য উল্লেখ করে আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, কেউ আগামী তিন বা চার মাসের আগে বলতে পারবে না অবস্থার উন্নতি কখন হবে। আপাতত বলা যায় উন্নতি অনেক কম। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের মানুষ স্বাভাবিক জীবন যাপন করছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাভাবিক জীবন এখনো ফেরেনি। ফলে যেখানে স্বাভাবিক সেখানে বিক্রি হচ্ছে। লস অ্যাঞ্জেলেস দুই সপ্তাহ আগে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে বের হয়েছে কিন্তু হঠাৎ করে কভিড আক্রান্ত বেড়ে গেছে। এখন এ সপ্তাহে বাড়ি থেকে মানুষ আর বের হচ্ছে না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ নিয়ে ডেমন্সট্রেশন চলছে, তারও প্রভাব আছে। বৈশ্বিক টেক্সটাইল ট্রেডিং কমেছে ৪০ শতাংশ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here