ইংল্যান্ডজুড়ে এ সপ্তাহেই খুলতে শুরু করেছে দোকানপাট, বিপণিবিতান। ফের ক্রেতাদের ভিড় বাড়ছে ফ্যাশন আউটলেটগুলোয়। তবে এই ফ্যাশনের পেছনের কারিগররা চাকরি হারাচ্ছেন। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের কারখানা মালিকরাও পড়েছেন বিপাকে। কারণ পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো একের পর এক অর্ডার বাতিল করছে। শ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্রেতাদের এই ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর হিসাবে, এ পর্যন্ত এক হাজার ১৫০টির বেশি কারখানার আড়াই শ কোটি পাউন্ড বা ২৬ হাজার ২৫০ কোটি টাকার অর্ডার বাতিল হয়েছে। ফলে কারখানা মালিকরা শ্রমিক ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক জানিয়েছেন, গত মাসে ২৫ হাজারের বেশি শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। তাঁর আশঙ্কা, বিদেশিদের অর্ডার না পেলে আগামী ছয় মাসে চাকরি হারানোর সংখ্যা পাঁচ লাখে পৌঁছাতে পারে।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে গত শনি ও রবিবার পৃথক দুটি প্রতিবেদনে করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের দুর্দশার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এর একটিতে চাকরি হারিয়ে চরম অনটনে পড়া পোশাক শ্রমিকদের বয়ান, অন্যটিতে ফুটে উঠেছে কারাখানা মালিকদের অসহায়ত্ব।
করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাবের জেরে গত মার্চে বিভিন্ন দেশে লকডাউন কার্যকর হয়। ফলে বন্ধ হয় দোকানপাট। এ প্রেক্ষাপটে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো বিশ্বব্যাপী তাদের সরবরাহকারীদের কয়েক মিলিয়ন পাউন্ডের অর্ডার বাতিল করে দেয়। বাতিলের তালিকায় শিপিংয়ের জন্য অপেক্ষমাণ পোশাকের অর্ডারও রয়েছে।
চাকরি হারিয়ে অভাবে শ্রমিক : পোশাক শ্রমিক নাজমিন নাহারের (২৬) হাতে দুই মাসের বেশি সময় ধরে খাবার কেনা বা ভাড়া দেওয়ার মতো টাকা নেই। দুই সন্তানের এই মা চলছেন ধারকর্জ করে। দীর্ঘ কর্মঘণ্টা সত্ত্বেও ম্যাগপাই নিটওয়্যারের চাকরিতে খুশি ছিলেন তিনি। মাসে ১৫০ পাউন্ড বা ১৫ হাজার ৭৫০ টাকা আয় হতো। বার্টন ও এইচএন্ডএমের মতো ব্রিটিশ ব্র্যান্ডগুলোর জন্য পোশাক তৈরি করে ম্যাগপাই নিটওয়্যার।
মার্চের শেষ দিকে বাংলাদেশ লকডাউনে গেলে নাজমিনের কারখানাটিও বন্ধ হয়ে যায়। গত ৪ এপ্রিল অন্যসব কারখানার মতো সেটি ফের খুললেও নাজমিনকে ‘না’ করে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ বলেছে, বিদেশি ক্রেতারা সব অর্ডার বাতিল করে দিচ্ছেন। ফলে নতুন কাজ নেই।’
তবে ম্যাগপাই নিটওয়্যারের অর্ডারদাতা এইচঅ্যান্ডএমের দাবি, তারা কোনো অর্ডার বাতিল করেনি। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ‘আমাদের কাছে থাকা তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত সব শ্রমিককে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।’
মাতালানসহ অন্যান্য পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে আল্টিমেট ফ্যাশন লিমিটেড। এই কারখানায় কাজ করতেন রোজিনা বেগম। তিনি জানান, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় কারখানার আরো ৩০০ কর্মীসহ তিনি চাকরিচ্যুত হন। তাঁর বেতন ছিল আট হাজার টাকা।
একটি ট্রেড ইউনিয়ন রোজিনাকে জানিয়েছে, কারাখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বলেছে, বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার বাতিল করায় তাদের ছাঁটাইয়ে যেতে হয়েছে। রোজিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের ভয় না থাকলে আমরা জোরালো প্রতিবাদ করতে পারতাম।’
নাজমিন ও রোজিনার মতো চাকরি হারিয়েছেন আঁখি আক্তারও। তবে তাঁর কারণ ভিন্ন। তিনি জানান, কভিডের লক্ষণসহ অসুস্থ হয়ে পড়ায় স্টার্লিং স্টাইলস কর্তৃপক্ষ তাঁকে চাকরিচ্যুত করে। তাঁর দুই মাসের বেতন বকেয়া। বেতন ছিল ৯ হাজার ৩০০ টাকা।
আঁখি বলেন, ‘গ্রামেও ফিরে যেতে পারছি না। সেখানে আমাদের কিছুই নেই। কী করব সেখানে? আমি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছি। কাজই আমাদের উপার্জনের একমাত্র উৎস।’ তিনি বলেন, অর্ডার কমে এসেছে। কারখানাগুলো শ্রমিকদের ছাঁটাই করছে।
আল্টিমেট ফ্যাশনের একজন মুখপাত্র বলেন, ‘কভিড এবং সামাজিক দূরত্বের কারণে আমাদের ৭০ শতাংশ শ্রমিক নিয়ে উৎপাদন পরিকল্পনা করতে হয়েছিল। এ জন্য সরকারি নিয়ম ও প্রবিধান মেনে আমাদের কিছু শ্রমিককে ছাড়তে হয়েছিল।’ তবে যোগাযোগ করেও আর্কাডিয়া, ম্যাগপাই নিটওয়্যার এবং স্টার্লিং স্টাইলসের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশে যদিও কারখানাগুলো ফের চালু হচ্ছে, তবে অর্ডারের পরিমাণ ৮০ শতাংশেরও বেশি কমেছে। ওয়ার্কার্স রাইটস কনসোর্টিয়ামের তথ্য অনুযায়ী, আর্কাডিয়া, প্রাইমার্ক, এডিনবার্গ উলেন মিলসহ ব্রিটিশ ব্র্যান্ডগুলো তাদের সব অর্ডারের জন্য বিদেশি সরবরাহকারীদের পুরো অর্থ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়নি।
অর্ডার বাতিলে দিশেহারা মালিক : চট্টগ্রামের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের মালিক মোস্তাফিজ উদ্দিন জানান, গত মার্চের শুরুতেই শিপিংয়ের জন্য প্রস্তুত ছিল ৩৮ হাজার পিস জিন্স। এর মূল্য দুই লাখ পাউন্ডেরও বেশি। সে সময় লকডাউনে যায় ব্রিটেন। এ জন্য এর ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আর্কেডিয়া অর্ডার বাতিল করে। এতে মাথায় হাত পড়ে এই কারখানা মালিকের।
ধনকুবের স্যার ফিলিপ গ্রিনের মালিকানাধীন আর্কেডিয়ার বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ড রয়েছে। যেমন—বারটন, ডরোথি পারকিনস, টপশপ। মোস্তাফিজের দাবি, ‘এই আর্কেডিয়ার দুই লাখ পাউন্ডের অর্ডারসহ ভবিষ্যতে দেওয়া হবে এমন কয়েকটি অর্ডারের জন্য বেশ কয়েক লাখ ডলারের মালামাল কেনেন। সব মিলিয়ে ২৪ লাখেরও বেশি পাউন্ডের ব্যাপার। এখন সবই গেছে।’ তাঁর হিসাবে, তাঁর কারখানার ৮০ শতাংশের বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছে, কিন্তু কোনো ক্ষতিপূরণ তিনি পাননি।
তবে আর্কেডিয়া এক বিবৃতিতে মোস্তাফিজের দাবি নাকচ করেছে। তারা বলেছে, দুই লাখ ডলারের অর্ডারটির বিষয় তারা বিবেচনা করছে। ভবিষ্যতে অর্ডার পাওয়া যাবে এমন চিন্তা থেকে ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের কেনাকাটার ব্যাপারে আর্কেডিয়ার আইনগত কোনো দায় নেই বলে জানান প্রতিষ্ঠানটির একজন মুখপাত্র।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, এখন যেহেতু ফ্যাশন হাউস ও আউটলেটগুলো ফের চালু হয়েছে, তাই সরবরাহকারীদের প্রতি ব্র্যান্ডগুলোর আর্থিক দায়বদ্ধতার প্রতি সম্মান দেখানো উচিত।
ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনের মেগ লুইস বলেন, ‘আমরা ফ্যাশন আউটলেটগুলোয় ভিড় দেখেছি। কিন্তু এই একই প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মীদের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময়টিতেই পরিত্যাগ করেছে।’ তিনি বলেন, ‘মহামারিতে নিজেদের আচরণের জন্য ব্র্যান্ডগুলোকে জবাবদিহি করতে হয়নি। একটি কারখানাকে দেওয়া অর্ডারের জন্য অর্থ পরিশোধ করা কোনো দাতব্য নয়। লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকার বিনিময়ে তারা নিজেদের মুনাফার সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে।’
তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গ্যাপ বলেছে, ‘আমরা ভেন্ডর বা সরবরাহকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ করেছি। কয়েক সপ্তাহ ধরে আমাদের অর্ডারগুলো মূল্যায়নের জন্য তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছি। সামনের মাসগুলোর জন্য পরিকল্পনা হাজির করেছি।’
আরেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মাতালান এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘ইতিমধ্যে ট্রানজিটে থাকা অর্ডারগুলোর প্রতি সম্মান জানাচ্ছি, যদিও সেসব পণ্য বিক্রি হবে না। অর্ডার বাতিল এড়াতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।’