শুল্কমুক্ত সুবিধায় (বন্ড সুবিধা) পণ্য আমদানি করে দুর্নীতি করেছে এমন অনেক প্রতিষ্ঠানের একাধিক তালিকা করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এসব তালিকায় তৈরি পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান বেশি। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে ব্যবহারের কথা বলে কাঁচামাল আমদানি করলেও তা উৎপাদনে ব্যবহার না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছেন। শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে অর্থপাচারের মতো গুরুতর অপরাধও করেছেন তাঁরা।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তাদের একাধিক টাস্কফোর্স পাঁচ মাস (জানুয়ারি-মে) রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের গত এক বছরের আমদানি-রপ্তানি ও উৎপাদনের তথ্য খতিয়ে দেখার পর এ তালিকা তৈরি করে। তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর আমদানি-রপ্তানি লাইসেন্স স্থগিত, বন্ড সুবিধা বাতিল এবং ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিন) বন্ধ করা হয়েছে।
সরকার রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম গতিশীল করতে বন্ড সুবিধা দেয়। রপ্তানি পণ্য উৎপাদনে এ সুবিধার আওতায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করা যায়। এর জন্য শর্ত দেওয়া আছে—প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কাঁচামাল আমদানি করা যাবে না। আর আমদানি করা কাঁচামালের সবটা পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করতে হবে। এ শর্ত ভঙ্গ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। শাস্তি হিসেবে বন্ড সুবিধা বাতিল, আমদানি-রপ্তানি স্থগিত এবং ব্যবসা চিহ্নিতকরণ নম্বর (বিন) বন্ধ করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে ওই সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা যাবে।
এনবিআরের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, টাস্কফোর্সের কর্মকর্তারা তদন্তে নিশ্চিত হন বাস্তবে অস্তিত্ব নেই, অকার্যকর বা উৎপাদনে থেকেও গত এক বছরে আন্ডার ও ওভার ইনভয়েসিং করে আমদানি-রপ্তানিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ১৩৫ প্রতিষ্ঠান আর্থিক অনিয়ম করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। তাদের হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এই ১৩৫ প্রতিষ্ঠানই তৈরি পোশাক খাতের। এর বইরে গত এক বছরে একটি প্লাস্টিক ও দুটি ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের হিসাব জব্দ করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাস্তবে অস্তিত্ব নেই কিন্তু কাগজে-কলমে প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা দেখিয়ে বন্ড সুবিধায় শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিয়েছে এমন ৮৩৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৬৯৯টি তৈরি পোশাক খাতের। আবার একসময় উৎপাদনে থাকলেও এখন আর উৎপাদনে নেই এমন অকার্যকর তিন হাজার ১৫৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুই হাজার ১৭টি প্রতিষ্ঠান তৈরি পোশাক খাতের। উৎপাদনে আছে এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও বন্ড দুর্নীতি করা পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান বেশি।
এসব প্রতিষ্ঠান মিথ্যা তথ্য দিয়ে পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেয়। আর প্রত্যেকবার কাঁচামাল আমদানির সময় কম দাম ও পরিমাণ পণ্য এনে বেশি দাম ও পরিমাণ দেখিয়ে বিপুল অর্থ পাচার করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে অর্থপাচার রোধে নতুন বিধান করা হয়েছে। আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে মিথ্যা তথ্য দিয়ে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং করে যে পরিমাণ আর্থিক অনিয়ম করা হবে তার ওপর ৫০ শতাংশ করারোপ করা হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে এ বিধান বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের উপকর কমিশনার মুহম্মদ আল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বন্ড সুবিধা নিয়ে অনেকে অর্থ পাচার করেছে, এনবিআরের তদন্তে এমনটা উঠে এসেছে। আবার বন্ড দুর্নীতি করে অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করেও বড় অঙ্কের আর্থিক অনিয়ম করেছে। বন্ড দুর্নীতির এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের প্রতিষ্ঠান বেশি।’
বন্ড দুর্নীতি করায় বছরে সরকার এক লাখ কোটি টাকার রাজস্ব হারায়। আবার বন্ড সুবিধা নিয়েও অনেকে হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করে না। বন্ড খাতে গত মে পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে তিন হাজার ৩৮ কোটি টাকা। কম আদায় হয়েছে এক হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা।
তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এবং তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভালোমন্দ সব খানেই আছে। সৎ ব্যবসায়ীরা আইন-কানুন মেনে ব্যবসা করছেন। অসত্রা বন্ড সুবিধা নিয়ে পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। অর্থ পাচারও করছেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি আরো বাড়ানো প্রয়োজন।’