গত শতকের সত্তর দশকে এদেশের তৈরি পোশাকের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ। রফতানি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় স্থানে থাকা এই অর্জন অনেক সময়ই অনেকের মাথা ব্যথার কারণ হয়েছে। বিশেষত প্রতিযোগীদের মধ্যে যখন রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই ক্ষমতাধর দেশ এবং এ অঞ্চলে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভরকেন্দ্র হিসেবে ক্রমশ তাদের অবস্থান শক্ত হচ্ছে তখন মাথাব্যথার সূত্রবদ্ধ দু’একটি কারণ শনাক্ত করাও সম্ভবত তেমন কঠিন নয়। তাছাড়া গত দু’দশকে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর অর্থনীতির মূল ঝোঁক অনুৎপাদনশীল খাতের দিকে হলেও বাংলাদেশ পোশাক শিল্পের মতো উৎপাদনশীল খাত নিয়ে বিশ্ব বাজারে দাপটের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। করোনার প্রভাব জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে নেতৃত্ব দিচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। ক্রেতারা আবার ফিরছেন। ফিরছে বাতিল হওয়া ক্রয়াদেশ। গত বছরের তুলনায় সত্তর আশি শতাংশ বেশি ক্রয়াদেশ আসছে। বছর কয়েক আগে সহিংসতার ভয়ে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সেসময় আশুলিয়ার এক শিল্প মালিক আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলেন, চোখের সামনে এভাবে কারখানা ধ্বংস হতে দিতে পারি না। দরকার হলে কারখানা বেঁচে দেব। এ শিল্পের সঙ্গে শুধু মালিক পক্ষের লাভ জড়িত নয়। এর সঙ্গে শ্রমিক, ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ, শিল্প ব্যাংক, বীমাসহ দেশের সার্বিক অর্থনীতি জড়িত। দু’হাজার দশ-এগারো অর্থবছরে দু’হাজার দু’শ’ বিরানব্বই কোটি ডলারের রফতানি আয়ের মধ্যে পোশাক খাত থেকে আয় হয়েছে এক হাজার সাত শ’ একানব্বাই কোটি ডলারেরও বেশি। তখন কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার রফতানি বন্ধ ছিল। অসংখ্য রফতানি আদেশ প্রত্যাহার হয়েছে। ক্রেতাদের কাছে যে ম্যাসেজ গিয়েছিল তাতে বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারানো তাদের জন্য ছিল স্বাভাবিক। বিজিএমইএ সভাপতি প্রচারমাধ্যমে জানিয়েছিলেন, পোশাক শিল্পে সহিংসতার প্রতিবাদে কারখানা বন্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন দেশের অন্য সব তৈরি পোশাক কারখানা মালিকরা। সহিংসতা বন্ধ না হওয়ায় তারাও কারখানা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে প্রতীকী চাবি তুলে দিয়েছিলেন তার হাতে। সব মিলে যে পরিস্থিতি তৈরি পোশাক খাতে চলেছিল তাকে সুস্থ বা স্বাভাবিক বলা যায় না। অনেকে মনে করেছেন নেপথ্যে হয়তো বড় ধরনের কোন হিসাব নিকাশের মহড়া ছিল। সব সহিংসতা ষড়যন্ত্র সামলে তৈরি পোশাক খাত এগিয়ে চলেছে। করোনা দুর্যোগেও আর্থিক স্থিতিশীলতার ভরসা দিচ্ছে। সামাজিক ব্যবসা, শেয়ার ব্যবসা, ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ওপর বীমা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসাকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতকে গত দু’দশকের বেশি সময় ধরে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদ। সেদিক থেকে বলা যায়, পুঁজিবাদের চরিত্রে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বিশেষ করে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলোর আর্থিক খাত উৎপাদনশীলতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উৎপাদনশীল খাতের চেয়ে অনুৎপাদনশীল খাতে পুঁজির লগ্নি বহুগুণ বেড়েছে। পঞ্চাশের দশকে মার্কিন অর্থনীতিতে মোট কর্পোরেট মুনাফার শতকরা আট ভাগ এসেছিল অনুৎপাদনশীল খাত থেকে। দু’হাজার সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় শতকরা একত্রিশ ভাগে। সে বছর অনুৎপাদনশীল আর্থিক খাতে মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা সাড়ে তিনগুণ ঋণ দেয়া হয়েছিল। পুঁজির এ অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থান বিশ্ব পুঁজিবাদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়। গত শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগের শতকরা নব্বই ভাগ ছিল বাণিজ্য ও উৎপাদনশীল খাতের সঙ্গে জড়িত। এই পুরো অংশ এখন চলে গেছে অনুৎপাদনশীল খাতে। এর আন্তর্জাতিক প্রভাব থেকে মুক্ত নয় বাংলাদেশও। আটাত্তর সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলা উৎপাদনশীল তৈরি পোশাক খাত সে সময় টলে উঠছিল। দারিদ্র্য ও বৈষম্য দূর করতে ক্ষুদ্র ঋণের ফর্মুলা এসেছিল এক সময়। এ পদ্ধতি নাকি ধন্বন্তরি, দাওয়াই দিয়েছিলেন আমাদের নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ। ইউনূস সেন্টারের আয়োজনে ওই অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী ভাষণে ড. ইউনূস বলেছিলেন সামাজিক ব্যবসার অর্থনৈতিক প্রভাবের কথা। বিদ্যমান অর্থনৈতিক কাঠামো আর প্রতিষ্ঠানের অব্যবস্থাপনায় মানুষ ভুগছে। দারিদ্র্য দূর হচ্ছে না, তাই দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য দূর করার জন্য সবাইকে সোচ্চার হতে বলেছেন। ব্যক্তির ‘অপরিসীম’ ক্ষমতায় বিশ্বাসী তিনি বলেছিলেন, ‘ব্যক্তি নিজেই সব কিছু বদলে দিতে পারে, তাই আমরা যদি সামাজিক ব্যবসার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখি, তাহলে দেখব অপরিসীম সম্ভাবনার এক নতুন পৃথিবী।’ কথাগুলোয় উত্তর আধুনিকতাবাদীদের কণ্ঠস্বরের প্রতিধ্বনিই শোনা যায় যেন। উত্তর আধুনিকেরা সংগঠিত জনশক্তিকে সমর্থন করেন না, কারণ সংগঠন মানে তাদের মতে ব্যক্তির জন্য কারাগার। এতে ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্ষুণœ হয়। তারা ঐক্যের রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন না, ব্যক্তির নিজস্বতার ওপর নির্ভর করতে চান। ড. ইউনূসও তাই। সামাজিক ব্যবসা নামের পরিবর্তনের চাবিকাঠি আসলে ব্যক্তিকে বিচ্ছিন্ন রাখার ঢাল-তলোয়ারের একটি উপাদান মাত্র। বিচ্ছিন্নতা সহিংসতা ছড়ায়, সংগঠন আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়। সামাজিক ব্যবসা, ওয়ার্ল্ড সোস্যাল ফোরাম ইত্যাদি অনুৎপাদনশীল খাতকেই উৎসাহিত করে। আমাদের শক্তিশালী উৎপাদনশীল খাত যেন সব অপপ্রভাব কাটিয়ে সুসংগঠিতভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে এগিয়ে যেতে পারে সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। পোশাক কারখানা চালু থাকা মানে অসংখ্য শ্রমিকের জীবনোপখ্যানের ভিত শক্ত থাকা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছোটখাটো অনেক উৎপাদনশীল খাত। পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকরা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশী-বিদেশী প্রসাধন কোম্পানি থেকে শুরু করে দেশী টেক্সটাইল, স্যান্ডেল-জুতা উৎপাদনকারী বহু প্রতিষ্ঠান। ফেয়ার এ্যান্ড লাভলী সানসিল্কের মতো প্রসাধনের এক বড় অংশের ক্রেতা পোশাক শিল্পের নারী শ্রমিকরা। তাদের আয়ের উৎস সচল থাকা মানে এসব কিছু সচল থাকা। তৈরি পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতি ঘুড়ে দাঁড়ানোয় সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। করোনা সঙ্কটেও রাখবে বলেই অর্থনীতি বিশারদরা মনে করছেন।