কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য গত ২৫ মার্চ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকার ঘোষিত এই বিশেষ ঋণ সুবিধা ব্যবহার করে শ্রমিকদের এপ্রিল, মে ও জুনের মজুরি পরিশোধ করেছেন সবচেয়ে বড় রফতানি খাত পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। এবার জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মজুরি পরিশোধের জন্য আরো সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেতে যাচ্ছে পোশাক খাত। এরই মধ্যে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল থেকে এমন প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। যদিও এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসেনি এখনো। গতকাল ২০২০-২১ অর্থবছরের রফতানি লক্ষ্য ঘোষণা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সভায় পোশাক খাতের প্রতিনিধিরা শ্রমিকদের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মজুরি পরিশোধের জন্য আবারো ঋণ সুবিধা ঘোষণার আহ্বান জানান। তাদের এ আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমান সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে পোশাক শিল্প মালিকদের পুনরায় ঋণ সুবিধা দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনার প্রতিশ্রুতি দেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সহসভাপতি ও পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান। প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে পুনরায় ঋণ সুবিধা পাচ্ছেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, সভায় আমরা বলেছি বাংলাদেশ ব্যাংকে কথা বলে একটা সার্কুলার করার ব্যবস্থা করতে, যাতে তহবিল থেকে অর্থ নিয়ে আমরা আগামী তিন মাস বেতন-ভাতা দিতে পারি। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে অর্থ নেয়ার পর আরো আড়াই হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হয়েছিল, যা সরকার ঘোষিত অন্য আরেকটি ৩০ হাজার কোটি টাকার তহবিল থেকে দেয়া হয়েছিল। তহবিলটি থেকে আবারো অর্থ নিয়ে আগামী তিন মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধের ব্যবস্থা হবে এমন আশা ব্যক্ত করে সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এবার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হতে পারে। তবে খুব সম্ভব সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার কমই প্রয়োজন হবে। আরেক দফা ঋণ সুবিধা দিতে আমরা এরই মধ্যে অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। এই চিঠির সূত্র ধরেই বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা যেহেতু বলেছেন এবং বাণিজ্যমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন, কাজেই আমরা আশা করছি যে তারা একটা ব্যবস্থা করবেন। পোশাক খাতের সবচেয়ে শ্লথ সময় যাচ্ছে এখন। একজন উদ্যোক্তা হারিয়ে গেলে নতুন উদ্যোক্তা পাওয়া খুব সহজ না। কাজেই এ সুবিধা পাওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করে দেশের তৈরি পোশাক খাতে। শুরুর দিকে প্রভাবটা পড়ে চীন থেকে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে। এরপর ইউরোপ ও আমেরিকাসহ প্রধান রফতানি গন্তব্যগুলোয় ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়লে রফতানিতে প্রভাব পড়তে শুরু করে। সেখানে চাহিদা ব্যাপক হ্রাস পাওয়ায় একে একে ক্রয়াদেশ বাতিল করতে থাকে ক্রেতারা। এরপর ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম কভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে শুরু করে। সংক্রমণ ঠেকাতে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ হয়ে যায় সব কলকারখানা। এ পরিস্থিতিতে শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধের জন্য গত ২৫ মার্চ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণার পর অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী ওই তহবিল থেকে ঋণ সুবিধা নিয়েছেন শিল্প মালিকরা। একপর্যায়ে তহবিলের বরাদ্দ শেষ হয়ে যায়। পরে সরকার ঘোষিত অন্য আরেকটি ৩০ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নিয়েছেন শিল্প মালিকরা। এ হিসেবে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধে প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে মোট সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা নেয়া হয়েছে। এখন মালিকরা আবারো তিন মাসের জন্য ঋণ সুবিধা পেলে তার পরিমাণও সাত থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকার মতোই হবে বলে খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমানের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়ে পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা ঋণ সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে আশাবাদী হলেও এরই মধ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে একই আহ্বান করে সাড়া পাননি তারা। গত ২২ জুন অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট দুই মালিক সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ। অর্থমন্ত্রী বরাবর পাঠানো চিঠির বিষয়ই ছিল নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারীদের জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর অর্থাৎ তিন মাসের বেতন-ভাতাদি প্রদানের জন্য অর্থ বরাদ্দ। চিঠিতে বলা হয়, তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা শিল্পের ভবিষ্যৎ ও শ্রমিকদের মজুরি প্রদানসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শ্রমিক-কর্মচারীদের জুলাই-আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০২০ মাসের বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পকে সহায়তা করার জন্য আগের মতো সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা একান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে চিঠিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি তৈরি পোশাক রফতানি বাণিজ্যের সক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে শ্রমিক-কর্মচারীদের আগামী তিন মাসের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করতে হবে। এজন্য আগের মতো সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান বিকেএমইএ সভাপতি সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান ও বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক।