দেশের ৮৫ শতাংশ রপ্তানি আয়ের গর্বিত খাত। ৪০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি। ফরমাল বা প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাত। আমাদের তৈরি পোশাক খাত। অর্থনীতির ভাষ্যে এই খাত লাভজনক, উৎপাদনশীল এবং দক্ষ শ্রমিকের কর্মস্থান। দেশের ৮৬ ভাগ শ্রমজীবী মানুষ জড়িত অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে, তাদের বিপরীত অবস্থানেই থাকার কথা পোশাকশ্রমিকদের; চাকরির নিশ্চয়তা, নির্ভরযোগ্যতা, যথাযোগ্য মজুরি, সর্বোপরি সুরক্ষা। কিন্তু ফুটপাতের খুদে ব্যবসায়ী বা হকার উচ্ছেদের মতো তাঁদেরও যখন-তখন খেদিয়ে দেওয়া যায়।
গত মাসের প্রথম তিন সপ্তাহেই ছাঁটাই করা হয়েছে ১০ হাজার ৯০৯ জন পোশাকশ্রমিককে। কারখানামালিকদের দেওয়া হিসাবে, করোনাভাইরাসের কারণে ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। পেরে উঠছেন না তারা। অতএব শ্রমিক ছাঁটাই। গত এপ্রিল থেকেই শুরু হয়েছে মালিকদের টিকে থাকার এই ‘সহজ অস্ত্রের’ ব্যবহার।
অথচ এই বৈশ্বিক মহামারির শুরুতে সরকার সর্বপ্রথম ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল ঘোষণা করে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য, বিশেষ করে পোশাকশ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি-ভাতা দিতে। এরই মধ্যে সেই সুবিধা নেওয়াও সারা কারখানামালিকদের। আবার নতুন করে তিন মাসের অর্থাৎ জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের মজুরি দিতে অর্থ বরাদ্দ চেয়েছে বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ।
শ্রম মন্ত্রণালয় গত এপ্রিলেই অনুরোধ জানিয়েছিল, ঈদুল ফিতরের আগে যেন শ্রমিক ছাঁটাই করা না হয়। ওই মাসেই বন্ধের সময় ৬৫ শতাংশ মজুরি দেওয়ার বিষয়ে শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে পোশাকশিল্পের মালিকদের সমঝোতা হয়। তখন মালিকেরা ঈদের আগে ছাঁটাই করা হবে না মর্মে প্রতিশ্রুতি দেন, এমনকী ছাঁটাই হওয়ার শ্রমিকদের পুনরায় নিয়োগ দেওয়ারও আশ্বাস দেন তারা। এই আশ্বাসের কিছুটা বাস্তবায়নও দেখা গিয়েছিল তখন। এরপর থেকে চলছে লাগাতার ছাঁটাই। গত বছরও দেশে ছাঁটাই হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক।
অর্থাৎ এসব প্রাতিষ্ঠানিক বা ফরমাল কর্মসংস্থানেও চাকরির নিশ্চয়তা নেই, ন্যায্য মজুরি নেই, পেনশন নেই, এমনকী সম্মানজনক বিদায়টুকুও নেই। শ্রমিক ছাঁটাইয়ে আইনের লঙ্ঘনের বিষয়টি নাকি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরও (ডিআইএফই) অবগত। তারপরও তারা আছেন মুখে কুলুপ এঁটে।
যেটুকু না হলে ঠিক মানুষের জীবন যাপন করা যায় না, বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের ক্ষেত্রে তা ২৫২ মার্কিন ডলার হওয়া দরকার বলে মনে করে অক্সফাম। অথচ তারা পান মাত্র ৫০ ডলার। বিশ্বের সাত শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পোশাকশ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। কম মজুরির মতো এর নিশ্চয়তাও এত কম যে লিখিত চুক্তিপত্র, মাসিক মাইনেই কেবল প্রাতিষ্ঠানিক খাতের পরিচায়ক নয়, এই কথাটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট করে তোলে।
একটা ফরমাল খাতের এর চেয়ে ‘উদোম’ ইনফরমালাইজেশন আর কি হতে পারে? স্বাধীনতার পাঁচ দশকে ইনফরমাল খাতের কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি তো হয়ই-নি, উল্টো ‘ফরমাল’ দাগিয়ে দেওয়ালগুলোর হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ছে!
ক্রয়াদেশ বাতিলের দোহাই দিয়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের হিড়িক পড়ে যায় যে খাতে, সেই খাত কতটা ‘ফরমাল’? আপৎকালে দুই মাসও শ্রমিকের দায়িত্ব নিতে পারে না একটা ৪০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ড্রাস্টি? শুধু বিদেশি ক্রেতাদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রপ্তানিমুখী শিল্পের ঝুঁকিটা এই করোনাকালে খোলাসা হলো। সস্তা শ্রমের সুযোগ নেওয়ার প্রবণতাও প্রবল বিদেশি ব্র্যান্ড বা ক্রেতাদের মধ্যে। এ কারণে এক দেশ থেকে অর্ডার আরেক দেশে অর্ডার সরিয়ে নেওয়া ডাল-ভাত তাদের কাছে। অটোমেশনের কারণে কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হওয়ার দিকটি আগামীতে আরও প্রবল হবে, সন্দেহ নেই।
পোশাকশিল্পের ওপর নি:সীম নির্ভরশীলতায় যারা চোখ বুঁজে আছেন, তাদের এখন একবার চারদিকে তাকানো দরকার। ৪০ বিলিয়ন ডলারের হিসাবের পাশে পড়ে থাকা শ্রমিকের বঞ্চনাটাও দেখুন। ৩০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ দেখতে পান, শয়ে শয়ে কফিনবন্দি অভিবাসী শ্রমিকের ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’ দেখতে পান না! সরকারি হিসাব বলছে, গত এক যুগে মধ্যপ্রাচ্য থেকে লাশ হয়ে ফিরেছেন ৩৩ হাজার তরুণ-যুবা। ৮ শতাংশ ডিজিপির দেশের বার্ষিক মাথাপিছু আয়ের হিসাবে আহ্লাদিত হন, করোনাকালে হাজারো মানুষের ত্রাণের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়াটা নজর এড়িয়ে যায়। এই ম্লান মানুষদেরও তো মাথাপিছু আয় এক হাজার ৯০০ ডলার! ঢাকা ছেড়ে হাজার হাজার মানুষের গ্রামমুখী চলমান ভগ্নযাত্রাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
বাড়বাড়ন্ত অর্থনীতির অন্যতম নিয়ামক নির্মাণ খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষাহীনতাও তারা আমলে নেন না। ফিবছর নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে হাড়গোড় ভেঙে, থেঁতলে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে শতাধিক শ্রমিকের করুণ মৃত্যুকাহিনি তাই কোথাও লেখা থাকে না। কৃষির বাম্পার ফলনে দেশের মুখের হাসি ফোটে, দুর্দশাগ্রস্ত কৃষকের মলিন মুখ দৃশ্যপটে গরহাজির।
নবম শক্তিশালী অর্থনীতি। শনৈঃ শনৈঃ প্রবৃদ্ধি। অস্ত্র আমদানিকারক শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ। ভাণ্ডারে আছে রাশিয়ান মিগ, চীনা ফাইটার জেট, সাবমেরিন। নিজেদের স্যাটেলাইট।
এত এত প্রাপ্তির আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়!