বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের প্রভাবে দেশের রপ্তানি আয়ে বড় ধস নেমেছে। প্রধান বাজার ইউরোপ-আমেরিকা ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমিত হওয়ায় সেখানে চাহিদা কমেছে। তীব্র সংকটে ব্যবসা গুটাচ্ছে তাদের বড় ব্র্যান্ডগুলো। নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে ডিভিএফ স্টুডিও, জেসি পেনি, নিম্যান মারকোস গ্রুপ, আলডো গ্রুপ, জন ভারভ্যাটরস, জে হিলবার্ন, ট্রু রেলিজিয়ন, ফরেভার ২১, জারা, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেট। পিয়ার ১ জারা তাদের এক হাজার ২০০ স্টোর বন্ধ করে দিয়েছে, লা চাপেল চার হাজার ৩৯১ স্টোর তুলে নিয়েছে। বৈশ্বিক এমন সংকটে চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের পোশাক খাত বিদায়ি অর্থবছরে খাতটি আয় হারিয়েছে ৫৩ হাজার কোটি টাকা। একই সঙ্গে ৪০ লাখ পোশাক শ্রমিক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছে।
বিজিএমইএ এবং রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তিন হাজার ৪০০ কোটি ডলার আয় হলেও গত এক বছরে আয় ১৮.৪৫ শতাংশ কমে হয়েছে দুই হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, সদ্যঃসমাপ্ত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পোশাকপণ্য রপ্তানি কমেছে আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ৬৩০ কোটি মার্কিন ডলারের। স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। পোশাক রপ্তানিতে এমন ভয়াবহ ধস আর হয়নি।
করোনার কারণে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মার্চে আয় কমে যায় ২০.১৪ শতাংশ, এপ্রিলে ৮৫.২৫ শতাংশ, মে মাসে ৬২.০৬ শতাংশ এবং জুনে ১১.৪৩ শতাংশ।
এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি কম হলেও নানা উদ্যোগের কারণে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম করোনার প্রভাব মোকাবেলা করে রপ্তানিতে গত অর্থবছরে ১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি করেছে। এ জন্য উদ্যোক্তাদের পণ্য বহুমুখীকরণ এবং উচ্চমূল্যে পণ্য রপ্তানি ও বিশেষায়িত যন্ত্রপাতি আমদানিতে সহজে আমদানির সুয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
জানতে চাইলে সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ কালের কণ্ঠকে বলেন, চলতি মূলধনের জন্য সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিলেও ওই সব প্রণোদনা উদ্যোক্তারা পাচ্ছেন না ব্যাংকগুলোর নানা জটিলতার জন্য। তিনি এসব ক্ষেত্রে বিজিএমইএর উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন যেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা থার্ড পার্টির গ্যারান্টির মাধ্যমে হলেও ওই ঋণ নিতে পারেন।
এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘যন্ত্রপাতি আমদানিতে সহজ শুল্ক প্রক্রিয়া ও প্রণোদনা দেওয়া হলে সহজেই ঘুরে দাঁড়াতে পারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। চীন বিশ্ববাজারের ৩৫ শতাংশ দখল করে আছে। সেখানে বাংলাদেশের শেয়ার মাত্র ৬ শতাংশ। চীনের দখলে থাকা বাজারের মাত্র ২ শতাংশও যদি বাংলাদেশ আয়ত্তে নিতে পারে, তাহলে আর পেছন ফিরে দেখতে হবে না আমাদের উদ্যোক্তাদের।’
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি শহীদুল আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পণ্য রপ্তানির চেয়ে চীনে পণ্য রপ্তানির সময় বা লিড টাইম প্রায় অর্ধেক। চীনে পণ্য পৌঁছাতে আমাদের মাত্র ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। আর যুক্তরাষ্ট্রে ও ইউরোপে লাগে ৩০ থেকে ৪৫ দিন। এ ছাড়া কোট ও স্যুটে বাংলাদেশের পণ্য জাহাজীকরণ করতে খরচও কম।’ তিনি আরো বলেন, ‘পোশাক খাতের মৌলিক পণ্য রপ্তানি করে জাহাজীকরণ বা এফওবি করে আমাদের আয় ১০ থেকে ১৫ ডলার। সেই দিক থেকে স্যুট ও কোটে তৈরি করে পাঠালে আয় থাকবে ১০০ থেকে ১৫০ ডলার। তা ছাড়া সম্প্রতি বাংলাদেশের সঙ্গে চীন বাণিজ্য আরো উদারীকরণ করেছে। দেশটি বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এই সুযোগ কাজে লাগানো গেলে দ্রুত ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশের পোশাক খাত।’ এ জন্য বাণিজ্যিক কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ডাব্লিউটিওর তথ্য মতে, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের প্রথম ১৫ দিনে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬.৭৩ শতাংশ। তবে এ সময় ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে ছাড়িয়ে গেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ভিয়েতনাম এ সময় আয় করেছে ৩৩৮ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.৯ শতাংশ; চীন আয় করেছে ৩২৬ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৮.৩ শতাংশ এবং বাংলাদেশ আয় করেছে ১৬৭ কোটি ডলার, প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯.৪ শতাংশ।
আশার কথা জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, করোনা শুরুর সময় পরিস্থিতি যতটা খারাপ ছিল, এখন তার থেকে অগ্রগতি হয়েছে। আগামী দিনে ইউরোপ ও আমেরিকার ক্রেতাদের বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের কেনাকাটা হবে। ফলে বাংলাদেশের সামনে ভালো সময় আসছে। কারণ সদ্যঃসমাপ্ত জুনে রপ্তানি তুলনামূলক ভালোই হয়েছে। এ জন্য এত দিন যে কম সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হতো, সেখানেও পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তিনি জানান, গত এপ্রিলে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল মাত্র সাড়ে ৩৭ কোটি ডলারের। মে মাসে হয় ১২০ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর জুনে এসে রপ্তানি হয়েছে ২১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের। এতে রপ্তানির নেতিবাচক ধারা থেকে বের হয়ে আসার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে।
অবশ্য পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর পরিচালক এহসান ফজলে শামীম বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ যেসব পোশাক তৈরি করে রপ্তানি করেছিল, তার মধ্যে বিদেশি ব্র্র্যান্ডগুলোর বিক্রি হওয়ার কথা ছিল গত মার্চ থেকে মে বা চলতি জুলাই পর্যন্ত সময়ে। এই সময়টা ইউরোপ ও আমেরিকায় গ্রীষ্মকাল। কিন্তু এবার করোনার কারণে যেহেতু বিক্রি তেমন হচ্ছে না, ফলে ওই সব পণ্য বায়ারদের কাছে রয়ে গেছে। এই কারণে আগামী সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশ নতুন ক্রয়াদেশ না-ও পেতে পারে।
বিজিএমইএ ইতিমধ্যে জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে প্রায় সোয়া তিন শ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়েছে। এসব কারণে কিছু ছোট পুঁজির কারখানা ইতিমধ্যে বন্ধও হয়ে গেছে। পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী দিনে আরো বেশ কিছু কারখানা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।