রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করে দেশের প্রথম যে ৪৮টি কারখানা কম্প্লায়েন্ট প্রতিষ্ঠান হিসেবে অনুমোদন পায় তার একটি ছিল চট্টগ্রামের ইস্টার্ন নিটওয়্যার। চলতি বছরের জানুয়ারিতেও এ কারখানায় প্রায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক কাজ করতেন। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়ার পর ক্রয়াদেশ হারাতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। তার ওপর শুরু হয়ে যায় শ্রমিক অসন্তোষ। একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে ১ জুলাই কারখানা বন্ধ করে দেন মালিক। কভিড-১৯-এর আঘাতে চট্টগ্রামের এ কারখানার মতোই দেশের ছয় শিল্প এলাকায় দুই হাজারের বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে গত দুই মাসে। এসব কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রধান কারণ ক্রয়াদেশ না থাকা। বন্ধ এসব কারখানা কবে খুলতে পারবেন, তা নিয়েও সংশয়ে আছেন মালিকরা। ঢাকার আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা—এ ছয় অঞ্চলে সব খাত মিলিয়ে শিল্প-কারখানা আছে সাড়ে সাত হাজারেরও অধিক। শিল্প কেন্দ্রীভবনের কারণে শিল্প এলাকাগুলোতে পোশাক কারখানার সংখ্যাই বেশি। ছয় শিল্প কারখানায় শুধু পোশাক খাতের কারখানাই আছে ২ হাজার ৮৯৩টি। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্র শিল্পের কারখানা আছে ৩৮৯টি। এছাড়া বেপজার আওতায়ও আছে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা। সব মিলিয়ে ছয় শিল্প এলাকায় মোট ৭ হাজার ৬০২টি কারখানার মধ্যে পোশাক খাতকেন্দ্রিক কারখানার সংখ্যা ৩ হাজার ৩৭২। এসব কারখানার বাইরে চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধ সব খাত মিলিয়ে অন্যান্য কারখানা আছে ৩ হাজার ৮৬৬টি। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনে কভিড-১৯-এর উত্পত্তির পর এর প্রাদুর্ভাব বাংলাদেশে শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ২৬ মার্চ বাংলাদেশে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। অল্পসংখ্যক কারখানা বাদে তখন ছয় শিল্প এলাকায় সাত হাজার কারখানা পর্যায়ক্রমে বন্ধ হয়েছে। শিল্প-কারখানার জন্য লকডাউন সীমিত করা হয় ২৬ এপ্রিল। সেই থেকে কারখানা পর্যায়ক্রমে খুলেছে। কিন্তু দুই মাস ধরে ছয় শিল্প এলাকায় গড়ে ২ হাজার কারখানা বন্ধই থাকছে। খাতভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ময়মনসিংহ এই ছয় শিল্প এলাকায় পোশাক শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য কারখানা আছে ১ হাজার ৮৮২টি। যার মধ্যে ৯ জুলাই ১ হাজার ৪৯২টি খোলা থাকলেও বন্ধ ছিল ৩৯০টি। আরেক সংগঠন বিকেএমইএ সদস্য কারখানা আছে মোট ১ হাজার ১০১টি। এর মধ্যে গত ৯ জুলাই খোলা ছিল ৫০৮টি, বন্ধ ছিল ৫৯৩টি। এলাকাভিত্তিক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, কারখানা সবচেয়ে বেশি বন্ধ নারায়ণগঞ্জ এলাকায়। ওই এলাকায় সব খাত মিলিয়ে মোট কারখানা আছে ২ হাজার ৪১১টি। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৩১টি কারখানা খোলা থাকলেও ৯ জুলাই বন্ধ ছিল ১ হাজার ১২৮টি কারখানা। ক্রয়াদেশ না থাকায় বন্ধ হয়ে পড়া পোশাক কারখানার একটি নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার বিসিক শিল্পনগরীর নীটবো নিটিং। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ফকির আসাদুজ্জামান জানান, করোনা সংকট শুরুর পর ২৮ মার্চ পর্যন্ত কারখানা চালু রেখেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে লকডাউন শুরু হলে বিসিকের অন্যান্য কারখানার মতো নীটবো কারখানার শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে কারখানা বন্ধ করে দেন। তার কারখানায় ৮৫০ জন শ্রমিক কাজ করতেন। সাধারণ ছুটি শেষ হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে কারখানা খোলা শুরু হলেও আর্থিক সংকট ও নতুন কোনো অর্ডার না থাকায় কারখানা চালু করতে পারেননি তিনি। নারায়ণগঞ্জের পরে কারখানা বেশি বন্ধ গাজীপুর এলাকায়। ওই এলাকার মোট ২ হাজার ৭২ কারখানার মধ্যে ৯ জুলাই খোলা ছিল ১ হাজার ৬৪৭টি, বন্ধ ছিল ৪২৫টি। চট্টগ্রামের মোট ১ হাজার ২২৯ কারখানার মধ্যে খোলা ছিল ৯০৮টি, বন্ধ ছিল ৩২১টি। আশুলিয়া এলাকায় মোট ১ হাজার ৩৫৬ কারখানার মধ্যে ৯ জুলাই খোলা ছিল ১ হাজার ২৩৫টি, বন্ধ ছিল ১২১টি কারখানা। খুলনা এলাকায় মোট ৩৫৫টি কারখানার মধ্যে খোলা ছিল ৩৪০টি, বন্ধ ছিল ১৫টি। ময়মনসিংহ এলাকার মোট ১৩১টি কারখানার মধ্যে ১৩০টিই খোলা ছিল, বন্ধ ছিল ১টি। শিল্প গোয়েন্দারা বলছেন, কারখানা বন্ধের কারণ কারখানাভেদে ভিন্ন। তবে মোটা দাগে কাজের অভাব যেমন বড় কারণ, আবার কারখানা মালিকের আর্থিক অসংগতিও আছে। শিল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারখানাগুলো উৎপাদন সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না কাজের ঘাটতিতে। আসন্ন মন্দা মোকাবেলায় শিল্প-কারখানাগুলো ব্যয় সংকোচনের পরিকল্পনা নিয়েছে। আবার উৎপাদন সক্ষমতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত কাজও নেই কারখানাগুলোয়। বর্তমানে কারখানাগুলো সাকল্যে উৎপাদন সক্ষমতার মাত্র অর্ধেক ব্যবহার করতে পারছে। অব্যবহূত থেকে যাচ্ছে বাকি অর্ধেক। এ ধারাবাহিকতায় অনেক কারখানা বন্ধই থাকছে। নিটওয়্যার খাতের কারখানা মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, কোনো কারখানাই সক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহার করতে পারছে না। ৩৫ শতাংশ সক্ষমতায় কারখানা সচল রেখেছে এমন ঘটনাও আছে। বড় কারখানাগুলোও ৬০ শতাংশের বেশি সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারছে না। এ ধারাবাহিকতায় অনেক কারখানা আর সচলই হয়নি। অনেকে স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। জানা গেছে, বিকেএমইএর ৮৩৮ সক্রিয় সদস্যের মধ্যে সরাসরি রফতানির সঙ্গে যুক্ত কারখানা রয়েছে ৭৩৭টি। সহসা সংগঠনটির সদস্য অন্তত ১০০ কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। শঙ্কা রয়েছে অনেক উদ্যোক্তারই ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ারও। পোশাক খাতসংশ্লিষ্টদেরও আশঙ্কা, অনেক কারখানা আর সচল হবে না। ফলে বিপুল পরিমাণ শ্রমিক কর্মসংস্থান হারাবে। গত ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১৫০টি কারখানার ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত হয়ে পড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে ২২ লাখ ৮০ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানে। বিজিএমইএর সর্বশেষ হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সংগঠনটির মোট সদস্য সংখ্যা ৪ হাজার ৬২১। গত মার্চেও সংগঠনটির সদস্যদের মধ্যে সরাসরি রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত কারখানা ছিল ২ হাজার ২৭৪টি। অন্যদিকে চলতি মাসে সরাসরি রফতানির সঙ্গে সম্পৃক্ত কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৯২৬টি। এ হিসাবে এপ্রিলের মধ্যে সরাসরি রফতানি কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত কারখানা বন্ধ হয়েছে ৩৪৮টি। এর অধিকাংশই চিরতরে বন্ধ হয়ে পড়েছে বলে দাবি বিজিএমইএর। অর্থাৎ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানে এরই মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাস। বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এ বিষয়ে বলেন, সম্প্রতি বন্ধের তালিকায় নতুন সংযোজন দেখা গিয়েছে। ৩৪৮টি কারখানার মধ্যে ২৬৮টি কারখানার কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে। বাকিগুলো স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে। এভাবে শিল্প সক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিফলিত হবে রফতানি ও কর্মসংস্থানেও। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কারখানাগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় বজায় রেখেছি। ক্রেতাদের সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি সরকারের সঙ্গেও সমন্বয় করছি। পরিস্থিতি মোকাবেলা ও উত্তরণের জন্য অনেক নীতিসহায়তার প্রস্তাবও আমাদের রয়েছে। সরকারের সঠিক নীতি-সহযোগিতায় অতীতের মতো এবারো সংকট থেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে যাব। বিজিএমইএ বলছে, পোশাক খাতে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো নতুন ঘটনা নয়। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর নিরাপত্তা ইস্যুতে হাজারেরও বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও বিনিময় হারের প্রভাবে আর্থিক সংকটের জেরেও কারখানা বন্ধ হয়েছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে কারখানা বন্ধ হয়েছে ৬০টিরও বেশি। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে কোনো শিল্পেরই পূর্ণ সক্ষমতায় চলার কাজ নেই। যার প্রতিফলন ঘটছে কারখানা বন্ধ হওয়ার চিত্রে। আগামী তিন-চার মাসে কেউ বলতে পারবে না অবস্থার উন্নতি কখন হবে। কাজ আসতে শুরু করলেও তা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম। তাই বলা যায়, আপাতত উন্নতি অনেক কম।