অলোকা রায় (ছদ্মনাম)। দৈনন্দিন বাজারের খরচ থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করে চার বছর আগে ২৫ হাজার টাকায় একটি সেলাই মেশিন কেনেন তিনি। শুরু করেন দর্জির কাজ। সেই দর্জির কাজ করেই চার বছরে কিনেছেন আর ছয়টি সেলাই মেশিন। গড়ে তুলেছেন ‘জেআর ফ্যাশন’। এই জেআর ফ্যাশনের আয় থেকেই চলে তার পাঁচ সদস্যের সংসার। নিজে কাজ করার পাশাপাশি চার নারীকে কাজের জায়গাও করে দিয়েছিলেন তার ছোট প্রতিষ্ঠানে। মেয়েদের জামা-কাপড় সেলাইয়ের পাশাপাশি ছোট-বড় গার্মেন্টসের পণ্য সাব কন্ট্রাক্টে করে দিতেন অলোকা। নারী হওয়ায় অনেক গার্মেন্টস মালিক কাজ করিয়ে টাকা দেয়নি। তারপরও তাকে ব্যবসা গোটানোর চিন্তা করতে হয়নি। কিন্তু করোনা তার ব্যবসার কোমড় ভেঙে দিয়েছে। অলোকা বলেন, ‘হাজার হাজার পণ্যের কাজ করিয়ে নিয়ে বিল দিত না। ঈদের আগের অনেক রাত শেষ করেছি সেসব গার্মেন্টস মালিকদের দরজায়। তারপরও লোন নিয়ে কর্মীদের বেতন পরিশোধ করেছি। এভাবে লোকসানে পড়েছি, আবার দাঁড়িয়েছি। কিন্তু এবার আর দাঁড়ানোর উপায় নেই। করোনা আমার এবং ব্যবসার কোমড় ভেঙে দিয়েছে। যারা এতদিন কাজ দিত, সেসব অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান কয়েক লাখ পাওনা টাকা না দিয়েই বন্ধ করে দিয়েছে। আমার একদিকে জমছে ঋণের কিস্তির পাহাড়, অন্যদিকে চার মাসের বাড়িভাড়া বকেয়া। পাওনাদারের ভয়ে বাসায় থাকতেও ভয় করে।’ বিশ্ব মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চরম সংকটে পড়েছেন অলোকার মত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা; যারা ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছেন। টানা ৬৬ দিন সাধারণ ছুটির সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখা এবং ছুটি শেষে সীমিত আকারে খুললেও খুব একটা লাভ হয়নি। ক্রেতা নেই, তাই লেনদেনও কম। উপরন্তু কারখানা ভাড়া, কর্মচারির বেতন ও পারিবারিক খরচ মেটাতে জমানো অর্থ খরচ করে চলেছেন এতদিন। এখন অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে গ্রামে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়ানোর উপায় খুঁজছেন। এভাবে চলতে থাকলে প্রায় এক কোটি শ্রমিক কর্মহীন হতে পারে বলে ধারণা সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন গবেষণা সংস্থার। নাইস লুক’র উদ্যোক্তা মাহমুদা আক্তার বলেন, ‘বছরের সবচেয়ে বড় ইনকাম হয় রোজার ঈদে। রোজার এক মাস ঘুম থাকে না। মাঝরাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। ঈদের সময়ে যে আয় করতাম তা দিয়ে পরের তিন চারমাস কর্মচারিদের বেতন ও দোকান ভাড়া ভালোভাবে চলে যেত। কিন্তু এবারের চিত্রটা একেবারেই ভিন্ন। এবার চার মাস ধরে ব্যবসা বন্ধ। এর মধ্যে রোজার ঈদও চলে গেছে। জমানো টাকা দিয়ে ১৪ জন কর্মচারির বেতন পরিশোধ করেছি। আবার এই ১৪ জনের মধ্য থেকে আটজনকে কাজ থেকে একেবারেই বাদ দিতে হয়েছে।’ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশে ১৫ জনের কম কর্মচারি কাজ করেন এমন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৫৪ লাখ। এসব প্রতিষ্ঠানে ৯৭ লাখ কর্মচারি কাজ করে। যদি এই এসব ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান ব্যবসা গুটিয়ে নেয় তবে প্রায় এক কোটি শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ফুটপাথে ব্যবসা করে কিংবা অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৬০ লাখ। যাদের কোনো লাইসেন্স নেই, ব্যাংকে লেনদেন নাই। কম পুঁজি দিয়ে দিনে ইনকাম দিনে শেষ- এমন ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে রয়েছেন। গত চার মাসে তাদের কেউই ব্যবসা করতে পারেনি। উল্টো পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেকের তো গ্রামে যাওয়ারও উপায় নেই। আমরা সরকারের কাছে অনেকবার বলেছি, এদের একেকজনের পুঁজি ৫০ হাজার টাকার বেশি নয়। এই টাকাটা পেলে তারা দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেত। ব্যবসায়ীরা কখনও দান চায় না। আমরা লোন চাই। সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করা গেলে এদের ব্যবসা গুটাতে হতো না।’ এদিকে ওয়ার্ল্ড এসএমই ফোরামের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ৭০ লাখ ৮১ হাজার শিল্পের মধে ৬০ লাখ ৮০ হাজার কুটিরশিল্প, ১ লাখ ১০ হাজার ক্ষুদ্রশিল্প, ৮ লাখ ৫০ হাজার ছোট শিল্প, ৭১ হাজার মাঝারি শিল্প এবং বড় শিল্পের সংখ্যা ৫২ হাজার। দেশে এসএমই খাতে কর্মসংস্থান রয়েছে ৭৩ লাখ শ্রমিকের। জানা যায়, বর্তমানে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ২৫ শতাংশ। ২০৪১ সালের মধ্যে তা ২৮ শতাংশে উন্নীত করার পরিকল্পনা ছিল সরকারের। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. ফরাস উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘করোনাভাইরাস পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর এ খাতে নজর দিলে এই সংকট দ্রুতই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘এখন যেহেতু মানুষ গ্রামমুখী হচ্ছে, তাই কৃষিখাতে বেশি জোর দিতে হবে। কারণ মানুষ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাদের সুযোগ দিতে হবে। না হলে দারিদ্রতা বাড়বে।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা কৃষি কাজে যুক্ত হবেন তাদের জন্য সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যারা আবারও ব্যবসা করতে চান কিন্তু পুঁজি নেই, তাদের জন্যও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।’ এদিকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষিত ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণও তারা পাননি। ব্যাংক লোন নেওয়ার পথও বন্ধ। কারণ ব্যাংক বিজনেস দেখে লোন দেয়। এখন সে পরিস্থিতি নেই। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম (সিপিডির গবেষক ও পরিচালক) সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এসএমই‘র দিকে নজর দিতে হবে। লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছে। তাদের ভবিষ্যত কী? যাদের ন্যূনতম কাজের সুযোগ আছে তারা কাজ করবে। যাদের একেবারেই কোনো সুযোগ নেই, তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। দারিদ্র নিরসনে সরকারকে বড় বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি এই ছোট ব্যবসায়ীদের পাশেও দাঁড়াতে হবে।’ অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা দেশের অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সংকট তৈরি করেছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, সংকটও বাড়তে থাকবে। এই পরিস্থিতি মাথায় নিয়েই মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি ও এসএমই খাতে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তারা।