Home বাংলা নিউজ পোশাক শিল্প : উন্নয়নের হাতিয়ার

পোশাক শিল্প : উন্নয়নের হাতিয়ার

বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত তৈরি পোশাক শিল্প, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও কৃষি খাতের ওপর দাঁড়ানো। রপ্তানি বৃদ্ধি, জিডিপিতে অবদান কিংবা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, সকল ক্ষেত্রেই তৈরি পোশাক খাত দেশের জন্য আশীর্বাদ। তৈরি পোশাক শিল্পে প্রতিবছর বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) ‘ওয়ার্ল্ড স্ট্যাটিসটিক্যাল রিভিউ ২০১৯’ প্রতিবেদন অনুযায়ী এককভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। চীনের পরই ছিল বাংলাদেশের অবস্থান। যদিও বিগত কয়েক বছর থেকে বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের মধ্যে অঘোষিত লড়াই চলছে। মোট পোশাক রপ্তানিতে চীনের হিস্যা ৩০ দশমিক আট শতাংশ। আর বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনের হিস্যা যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ও ৬ দশমিক ২ শতাংশ। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ৬১০ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। অন্যদিকে একই সময়ে ভিয়েতনাম থেকে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৯৩০ কোটি ডলারের পোশাক। বৈশি^ক পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় মূলত ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু একক দেশ হিসেবে চীনের পর বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের অবস্থান। গত দশ বছরে মোট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের হিস্যা বেড়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। পোশাক রপ্তানিতে এই উন্নতির পেছনে যাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তারা হলেন তৈরি পোশাক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতি বছর দেশ আয় করছে হাজার হাজার কোটি ডলার। তারপরেও পোশাক শ্রমিকরা দিন দিন বিভিন্ন ভোগান্তির স্বীকার হয়। বকেয়া বেতন পরিশোধ না করা, অবৈধ ছাঁটাই, শ্রমিকদের উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগের অভাব, কাজে অনিরাপত্তাসহ বিভিন্ন ধরনের অসন্তোষ লেগেই থাকে। মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে যথেষ্ট সমন্বয়হীনতাও দেখা যায়। করোনার কারণে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো লকডাউন পন্থায় হাঁটে। ফলস্বরূপ দোকান পাট, শপিংমল বন্ধ থাকায়, গত মার্চ মাস থেকে দেশের পোশাক শিল্প সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মহামারির কারণে বিভিন্ন দেশের বিপুল সংখ্যক ক্রয়াদেশ স্থগিত ও বাতিল হওয়ার কারণে মালিকপক্ষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। যদিও রপ্তানিমুখী এই খাতে পোশাক শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার জন্য সরকার প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল ঘোষণা করেছে। আর সেই তহবিলের বড় অংশই নিয়েছেন পোশাক শিল্পের মালিকরা। শিল্প মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক কেবল এ খাতের উন্নয়ন ছাড়াও সমগ্র অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরি। মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকে। এ সমস্যার সমাধানে শ্রমিকবান্ধব উদ্যোগ নিতে হবে। এ শিল্পের অধিকাংশ শ্রমিকই নারী। যারা দেশের বিভিন্ন জায়গার দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে এসেছে। স্বাধীনতার পর দেশ শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। কাঁচামাল ও পাটজাত পণ্য ছাড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্য ছিল না বললেই চলে। পরবর্তীকালে পোশাক শিল্পের হাত ধরেই আমরা বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছি। ১৯৮১-৮২ সালে পোশাকে শ্রমিকদের সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ হাজার। সময়ের স্রোতে চলমান থেকে বর্তমানে ১ হাজার ৮৯টি কারখানায় পোশাক শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের উর্ধ্বে। পোশাক রপ্তানি করেই দেশের আমদানি রপ্তানির যে ব্যবধান, তা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। শিল্পায়নের উন্নয়নে প্রয়োজন অধিক শিল্প উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা। বিশ্বের শিল্পোন্নত সকল দেশের উন্নয়ন সাধনে এই উদ্যোক্তাদের ভূমিকাই জোরাল ছিল। নতুন নতুন পণ্য তৈরি, গুণগত মান বৃদ্ধি করা, শ্রমিকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দেওয়া শিল্পোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পোশাক শিল্পে অধিক মুনাফা লাভ করতে হলে আমদানি বিকল্পায়ন কৌশল গ্রহন করতে হবে। যদিও বর্তমানে পোশাক শিল্পের কাঁচামাল অনেকটাই আমদানি নির্ভর। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। কোটি কোটি মানুষের এই সংখ্যাকে আমাদের মানব সম্পদে পরিণত করতে হবে। কেবল খনিজ সম্পদে ভরপুর থাকলেই একটি দেশ উন্নত হয় না। খনিজ সম্পদে ভরপুর থাকলেও বিশ্বের অধিকাংশ দেশ দরিদ্র। আর এই দারিদ্রতাকে হ্রাস করতে হলে প্রয়োজন দক্ষ মানব সম্পদের। দক্ষ জনবলই পারে একটি দেশকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে। দেশের অবহেলিত নারী সমাজের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এই খাতের উন্নয়ন প্রয়োজন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন কৃষি কেন্দ্রিক হলেও, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশ শিল্পখাতে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এই পোশাক শিল্পই অভাবনীয় সফলতার দুয়ার খুলেছে। নারীদের সম্পৃক্ততা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা সময় বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ দরিদ্র, দুর্নীতিগ্রস্ত, রাজনৈতিক অস্থিরতার দেশ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু আজ বিশ্ব বাজারে আমাদের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। দিন দিন দেশের অবস্থান আরও সক্রিয় হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে সরকারসহ এ খাতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন হতে হবে। পোশাক রপ্তানি করার জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। যাদের হাত ধরে এই পোশাক শিল্প দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কল্যাণের জন্য কাজ করতে হবে। যদিও অভিজ্ঞ জনবল সৃষ্টি, দক্ষ উদ্যোক্তা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, মালিকপক্ষ ও শ্রমিকের সমন্বয়, উপযুক্ত পরিবেশ ইত্যাদির মাধ্যমেই এ শিল্প টিকে থাকে। কিন্তু বাস্তবতা হল, দেশের এ শিল্পের বিকাশের কারণ মূলত সস্তা শ্রম। অন্যান্য দেশের শ্রমিকদের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের বেতন-বোনাস সুবিধা খুবই কম। মালিকপক্ষের এই ব্যাপারে অনীহা লক্ষ করা যায়। এ ধরনের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেতন-ভাতা ছাড়াও কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ ও নিরাপত্তাজনিত কারণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা যায়। প্রায়ই শ্রমিকরা অগ্নিকা- ও দুর্ঘটনার শিকার হয়। ২০১১ সালের রানা প্লাজার সেই দুর্ঘটনার কথা হয়ত জাতি কোনোদিনই ভুলতে পারবে না। যেহেতু একটি কারখানায় অসংখ্য মানুষ কাজ করে, সেহেতু তড়িঘড়ি না করে যেকোনো জায়গায় অথবা আবাসিক বাসা-বাড়িতে কারখানা স্থাপন করা কখনোই সমীচীন নয়। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। তৈরি পোশাক শিল্প আমাদের জন্য এক সম্ভাবনাময় খাত। সুতরাং উৎপাদনশীলতা ও গুণগত মান উন্নয়নে বেশি জোর দিতে হবে। বিশ্ব বাজারে চীনসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিকদের কম মজুরি দিয়ে স্বল্পমূল্যের পণ্য তৈরি না করে পণ্যে বৈচিত্র্য ও বাজারকে সম্প্রসারণ করতে হবে। শিল্পায়নের হাত ধরেই একটি দেশের উন্নতি ত্বরান্বিত হয়। শিল্পায়ন ছাড়া কোনো দেশ উন্নত হয়েছে এমন উদাহরণ খুবই কম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here