বিদেশফেরত বাংলাদেশিদের মাধ্যমে দেশে প্রথম করোনাভাইরাস সংক্রমণ ছড়ানোর পর সবচেয়ে বড় ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল পোশাক খাতের লাখ লাখ কর্মী আর বস্তিবাসী। তাদের মধ্যে সংক্রমণের তীব্রতা বেশি হলে দেশে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক বেশি হবে বলেই বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে প্রায় সাড়ে পাঁচ মাসের কাছাকাছি সময়ে এসে এখন দেখা যাচ্ছে, পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা তুলনামূলক খুবই কম। এমনকি মৃত্যুর ঘটনাও একেবারে ‘নগণ্য’, যা রীতিমতো বিস্মিত করেছে বিশেষজ্ঞদের। পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, তাঁরা সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব ধরনের কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। অন্যদিকে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও দাবি করা হচ্ছে, যেসব এলাকায় পোশাক শ্রমিকদের বসবাস, সেখানেও নজর রাখা হয়েছিল। স্বাস্থ্যবিধি মানা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল কারখানা ও আবাসনে। উল্লেখ্য, মার্চ মাসে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর তৈরি পোশাক কারখানার কর্মীদের অনেকে বাড়ি চলে যান। এরপর একপর্যায়ে গ্রাম থেকে আবার ঢাকায় নিয়ে আসার ঘটনায় ব্যাপক তোপের মুখে পড়েন পোশাক কারখানার মালিকরা। পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠনের নেতারাও বেশ কিছুদিন সমালোচিত হন। পরবর্তী সময়ে রোজার ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামে যাওয়া এবং ঈদের পরে গ্রাম থেকে ঢাকায় ফেরার ক্ষেত্রেও সবার দৃষ্টি ছিল এই পোশাক খাতের কর্মীদের ওপর। গাজীপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. খাইরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশে করোনা সংক্রমণের পরপরই অন্য সবার মতো আমরাও পোশাক খাত নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম। তার ভিত্তিতেই কারখানাগুলোতে দ্রুত সময়ের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ চালানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল। বেশির ভাগ কারখানায় উপযুক্ত মাত্রায় স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করা হয়েছে। যে কারণে দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ খাতের কর্মীদের মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা গেছে। সেটা করা না গেলে হয়তো সবার আশঙ্কাই সত্যি হতো।’ ওই সিভিল সার্জন বলছেন, ‘সংক্রমণ শুরুর পর পর আমরা একটি পোশাক কারখানায় পরীক্ষামূলকভাবে একটি জরিপ চালিয়েছিলাম। তখন দেখেছি, ওই কারখানায় শতকরা ৪০ ভাগ হারে পজিটিভ রিপোর্ট আসছে। সেটি সামনে রেখেই আমরা স্থানীয় মেয়র, জেলা প্রশাসন ও কারখানা মালিকদের সঙ্গে সমন্বিতভাবে সর্বোচ্চ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন আমরা দেখছি, অন্য কমিউনিটির চেয়েও গার্মেন্টকর্মীদের মধ্যে সংক্রমণের মাত্রা খুবই কম। অর্থাৎ গাজীপুরে সব মিলিয়ে প্রায় ২০ লাখ পোশাককর্মীর মধ্যে মাত্র ৪০০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন মাত্র একজন। তবু আমরা থেমে নেই, এখন আমরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছি।’ ডা. খাইরুজ্জামান বলছেন, শুধু পোশাক কারখানাগুলোতেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, বরং কর্মীরা যেখানে বসবাস করেন সেখানেও স্বাস্থ্যকর্মীরা খুঁজে খুঁজে তাঁদের বের করে সতর্ক করেছেন। তাঁরা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কি না সেগুলো পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখনো স্বাস্থ্য সহকারীরা প্রতিটি ওয়ার্ডে পোশাক কারখানার কর্মীদের মধ্যে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। গাজীপুরের সিভিল সার্জন বলেন, যেসব পোশাককর্মী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যেও তেমন কোনো জটিল উপসর্গ ছিল না। হাসপাতালে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিযোগও ছিল একেবারেই হাতে গোনা। তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারদের সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা যায়, দেশে চার হাজারের বেশি পোশাক কারখানায় প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন। সরকারের স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে কারখানা খোলা, বিজিএমইএ অডিট টিমের নিয়মিত কারখানা পরিদর্শন, সুরক্ষার বিষয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ কার্যকর করার ফলে পোশাক কারখানাগুলোতে তেমন সংক্রমণ ছড়ায়নি। গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিজিএমইএর তালিকাভুক্ত কারখানাগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫১১ জন। এর মধ্যে ৪৪৫ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। বাকিরা চিকিৎসাধীন। তবে কতজন শ্রমিক মারা গেছেন, সেই তথ্য দেয়নি সংগঠনটি। অবশ্য গত ২২ জুন কালের কণ্ঠে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে শিল্প পুলিশ সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়, ওই দিন পর্যন্ত ৪১৭ জন পোশাক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর মারা গেছেন পাঁচজন। এরপর আর হালনাগাদ তথ্য দেয়নি শিল্প পুলিশও। একই দিন অন্য একটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, আক্রান্ত ও মৃত্যুর এই হিসাব ১৭৪টি পোশাক কারখানার। আক্রান্তদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ২২১ জন। বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত ৬৫টি কারখানায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২১৪ জন, সুস্থ হয়েছেন ৭৭ জন আর মারা গেছেন চারজন। বিকেএমইএর ৩১টি কারখানায় ৯৩ জন আক্রান্ত, সুস্থ হয়েছেন ৭১ জন। বিটিএমএর তিনটি কারখানায় চারজন আক্রান্তের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন দুজন। বেপজার (বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল) ৫১টি কারখানায় ৭০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৫২ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা ছোট পরিসরে করোনা আক্রান্তদের পেশাগত বিভাজন খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। সেখানে তিন হাজার আক্রান্তের মধ্যে দেখেছি মাত্র ১.৫ শতাংশ গার্মেন্ট শ্রমিক। আইইডিসিআরের এই হিসাব গার্মেন্ট মালিকদের দেওয়া হিসাবের চেয়ে বেশি হলেও দেশে মোট আক্রান্তদের ভেতর গার্মেন্ট শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের মতো। মোট ৪০ লাখ গার্মেন্ট শ্রমিকের মধ্যে শতকরা হিসাবে সেই হার দাঁড়ায় মাত্র ০.০৮ ভাগ। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নির্ণয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সত্যিই আমরা গার্মেন্ট সেক্টরের (পোশাক খাত) শ্রমজীবী মানুষদের নিয়ে খুব বেশি মাত্রায় উদ্বিগ্ন ছিলাম। তবে এখন দেখছি, সেই হারে সংক্রমণ ঘটেনি। এটা হয়তো গার্মেন্ট সেক্টরের মালিকদের ও প্রশাসনের কার্যকর প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থার কারণে সম্ভব হয়েছে। তবু বলব, এখনো সেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা চালিয়ে যেতে হবে।’ ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, সম্প্রতি আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআর,বি (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ) মিলে ঢাকায় একটি জরিপের মাধ্যমে দেখা গেছে, বস্তিবাসীর মধ্যে সংক্রমণ মাত্র ৬ শতাংশ আর ঢাকায় গার্মেন্ট শ্রমিকদের বেশির ভাগই বস্তি এলাকা বা বস্তির মতো আবাসিক পরিবেশে বসবাস করে। ফলে এই সংক্রমণের হার তুলনামূলক খুবই কম। আইইডিসিআরের নবনিযুক্ত পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকায় আমরা যে সার্ভিস করেছি সেখানে আমাদের সামনে যে পরিসংখ্যান উঠে এসেছে তাতে করে আমরা বলতেই পারি, গার্মেন্ট শ্রমিক ও বস্তিবাসীদের মধ্যে সংক্রমণের হার তুলনামূলক অনেক কম। আগে আমরা যেভাবে আশঙ্কা করেছিলাম, সেটি হয়নি। তবে কেন এই শ্রেণির মানুষের মধ্যে সংক্রমণ মাত্রা কম, তা খুঁজে দেখার জন্য আমাদের কাজ চলছে। আশা করি, শিগগিরই আমরা তা জানাতে পারব।’ বিজিএমইএর উদ্যোগের কথা তুলে ধরে সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আবদুস সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খোলার সময় আমরা ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ রেশিও (অনুপাত) মেনে কারখানা খুলেছি। কারখানার ভেতর ঢুকতে হাত ধোয়া, তাপমাত্রা মাপা এবং কারখানায় সামাজিক দূরত্ব মানা হয়েছে কঠোরভাবে।’ নিট পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের স্বাস্থ্যবিষয়ক দিকনির্দেশনা এবং কারখানায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) দিকনির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করার ফলে পোশাক খাতের শ্রমিকদের তেমন আক্রান্ত করতে পারেনি।’ রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা পরিচালনা করায় করোনার প্রভাব তেমন একটা প্রতিফলিত হয়নি পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে। এ ছাড়া যারা পরিশ্রম করে, তাদের মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম। শারীরিক সক্ষমতার কারণে আক্রান্ত হলেও অনেকে বুঝতেও পারেনি।’ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পোশাক খাতে শ্রমিকরা বয়সে তরুণ, ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী। এই বয়সের মানুষ পরিশ্রমী হয়। ফলে আক্রান্ত হয়েছে কম। এ ছাড়া কারখানায় সামাজিক দূরত্ব, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা হয়েছে। সচেতনতামূলক কার্যক্রমও শ্রমিকরা তাদের আবাসনে কঠিনভাবে প্রতিপালন করেছে।’