গেল সপ্তাহের একটি খবর ছিল, পোশাক রফতানিতে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টপকে গেছে। বিগত বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক বাজারে রফতানির ক্ষেত্রে চীন ছিল প্রথম স্থানে, দ্বিতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম ছিল তৃতীয় অবস্থানে। তবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানের মধ্যে ফারাকটা খুব বেশি ছিল না। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ ৩৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রফতানি করে, যা বিশ্ববাজারের প্রায় ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনাম করেছিল ৬ দশমিক ২ শতাংশ এবং পরিমাণটা ছিল ৩১ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের কারণে বাজারে চাহিদার ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারপরও ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন এই ৬ মাসে বাংলাদেশ রফতানি করতে পেরেছে মাত্র ১১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে ভিয়েতনাম রফতানি করেছে ১৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আমাদের দেশে প্রথম লকডাউন হয় ২৫ মার্চ। কিন্তু রফতানি প্রবণতা লক্ষ করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ জানুয়ারিতে রফতানি করেছে ৩.০৪ বিলিয়ন, ফেব্রুয়ারিতে ২.৭৮, মার্চে ২.২৬ এবং এপ্রিলে সর্বনিম্ন মাত্র ০.৩৭ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভিয়েতনামের রফতানি ছিল জানুয়ারিতে ১.৪৭, ফেব্রুয়ারিতে ২.২৩, মার্চে ২.৩৪ এবং এপ্রিলে কমে ১.৬১ বিলিয়ন ডলার হলেও তা বাংলাদেশের তুলনায় ৪ গুণেরও বেশি। তার মানে হল, করোনার কারণ বাদ দিলেও ভিয়েতনামের রফতানি বছরের শুরু থেকে ছিল ঊর্ধ্বমুখী আর বাংলাদেশের ছিল নিম্নমুখী। এটা ঠিক, করোনা ভিয়েতনামকে আমাদের মতো করে আক্রান্ত করতে পারেনি। ২১ আগস্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৯০ হাজার আর মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৮৬১। অন্যদিকে ৯ কোটি ৬০ লাখ মানুষের দেশ ভিয়েতনামে আক্রান্ত হয়েছেন মাত্র ১০০৯ জন এবং মারা গেছেন ২৫ জন। তারপরও বলা চলে, ভিয়েতনামের এগিয়ে যাওয়াটা কৌশলগত সক্ষমতাও হতে পারে। এটাকে আমাদের পোশাক শিল্পের ‘অশনিসংকেত’ বলা যাবে না; তবে অধিকতর মনোযোগী হওয়ার দাবি রাখে। এ বছরের এপ্রিল মাসে আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছি। মার্চ মাসের তুলনায় এপ্রিলে রফতানি প্রায় ৮৫ শতাংশ কমে গেছে, যা পোশাক রফতানির ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে, আসলে যে সময়টাকে বিবেচনা করে আমরা মন্তব্য করছি সেটি একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। সারাবিশ্বই এখন একটি অনিশ্চয়তার পেছনে হাঁটছে। এর শেষ ঠিক কোথায় তা এখনও নির্ধারণ করা যায়নি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বাজার প্রায় ৩০টি দেশ হলেও মূলত তা ইউরোপ ও আমেরিকায়। তাদের চাহিদার ঘাটতি হলে এর প্রভাব আমাদের ওপর পড়বেই। বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘কোনো ক্রেতাই এখন আর শার্ট-প্যান্ট কিনবে না, কিনবে খাবার ও ওষুধ।’ সে সময়ে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রাইমার্ক এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন ও অস্ট্রিয়ায় তাদের সব স্টোর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। শুধু ব্রিটেনজুড়েই এই ব্র্যান্ডের ২০০টি স্টোর রয়েছে। অন্যদিকে আরেকটি বিখ্যাত ব্র্যান্ড জারা সারা বিশ্বে প্রায় ৪ হাজার স্টোর বন্ধ করে দিয়েছিল। সুতরাং এর প্রভাব থেকে আমাদের মুক্ত থাকার কথা নয়। তবে যেহেতু জুন মাসে এসে রফতানি বেড়েছে, তাই ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় হবে, তা বছর শেষের আগে মন্তব্য করাটা হবে ‘টু আরলি’। সঙ্গত কারণেই বিশ্লেষকরা বলছেন, এ নিয়ে হতাশ হওয়ার মতো পরিস্থিতি এখনও আসেনি। তারপরও পোশাক খাতের যে কোনো শঙ্কার কথা শুনলে আমরা আঁৎকে উঠি। আমাদের কাছে এটি একটি সংবেদনশীল খাত। দেশের জিডিপির খাতওয়ারি অবদান খতিয়ে দেখা যায়- কৃষির অবদান ১৪.২৩ শতাংশ, সেবা খাতের অবদান ৫২.১১ শতাংশ আর শিল্প খাতের অবদান ৩৩.৬৬ শতাংশ। শিল্প খাতের ৩০ শতাংশই হচ্ছে পোশাক এবং আমাদের মোট রফতানির প্রায় ৮৩ শতাংশ জোগান দিচ্ছে এ খাত। দেশের প্রায় ৫ হাজার প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক যার ৮০ শতাংশই নারী। তাই কর্মসংস্থানের দিক বলুন কিংবা নারীর ক্ষমতায়ন, পোশাক শিল্প সব সময়ই আমাদের চোখের সামনে থাকে। তাছাড়া এ শিল্পের রয়েছে একটি দীর্ঘ ইতিহাস। এদেশের পোশাক রফতানির আয়োজন ষাটের দশকের শেষদিকে শুরু হলেও এটি প্রকৃতই একটি রফতানিমুখী খাতে রূপ লাভ করে সত্তরের দশকের শেষে। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আমাদের রফতানির প্রায় ৫০ শতাংশই ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য এবং সেক্ষেত্রে এ খাতটি শীর্ষে অবস্থান করছিল। আশির দশকের শেষটায় পোশাক খাত পাটকে টপকে যায়। ১৯৯৯ সালে পোশাক খাতে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। তাছাড়া এ খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য খাত যেমন- কাপড়, সুতা, প্যাকেজিং, পরিবহন, ইনসুরেন্সসহ সহযোগী খাতগুলোয় প্রায় ২ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রফতানিতে পোশাক খাতের অবদান ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ, যা বর্তমানে ৮৩ শতাংশ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ খাত সম্প্রসারিত হয়ে দুটি উপখাত তৈরি করে, একটি হল ওভেন উপখাত, অপরটি নিট উপখাত। প্রথমদিকে ওভেন উপখাতেরই দাপট ছিল। ২০০২ সালে মোট রফতানির ৫২ শতাংশ ছিল ওভেন উপখাতের, আর নিটিং ছিল মাত্র ৯ শতাংশ। কিন্তু মাত্র ৬ বছরের মাথায় ২০০৮-০৯ অর্থবছরে নিটিং ওভেনকে ছাড়িয়ে যায়। এ সময়ে নিটিংয়ের অংশ দাঁড়ায় ৪২ শতাংশে আর ওভেন পড়ে থাকে ৩৮ শতাংশে। দেশে পোশাক শিল্পের বিকাশে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ বেশকিছু কারণ রয়েছে। বাহ্যিক কারণের প্রথমটি হল গ্যাট অনুমোদিত ‘মাল্টি ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টে’র (এমএফএ) অধীনে কোটা পদ্ধতি। বাংলাদেশের জন্য এটি আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। তাছাড়া কোনো কোনো দেশ যেমন শ্রীলংকাসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রমবাজারে মজুরি দ্রুত বৃদ্ধি পায়। তাই ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশ একটি পছন্দের জায়গা হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ যে কারণটি তৈরি পোশাক বা আরএমজি গড়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে তা হল তুলনামূলক সুবিধা। আর এই সুবিধার কারণ সস্তা শ্রম এবং পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষণযোগ্য শ্রমিকের সরবরাহ। সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতিমালাও এই শিল্প গড়ে ওঠার পেছনে অবদান রেখেছে। সরকারের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে রয়েছে ব্যাক টু ব্যাক এলসি (লেটার অব ক্রেডিট), পণ্য গুদামজাতকরণ সুবিধা (শুল্ক আদায় সাপেক্ষে), হ্রাসকৃত সুদে ঋণ, নগদ রফতানি সুবিধা, রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা তৈরি ইত্যাদি (উইকিপিডিয়া)। তারপরও পোশাক খাত পুরোপুরিভাবে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আমরা যদি প্রতিযোগী দেশগুলোর দিকে তাকাই তাহলে দেখব হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও অন্যান্য দেশের তুলনায় শ্রমিকের উৎপাদনশীলতায় আমরা খানিকটা পিছিয়ে। তাছাড়া আমাদের ব্যবহৃত যন্ত্রাংশের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে, সর্বাধুনিক নয়। কাঁচামালের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় আমদানিনির্ভরতা এ খাতের আরেকটি দুর্বল দিক। রয়েছে অবকাঠামাগত সীমাবদ্ধতা। রফতানির ক্ষেত্রে বন্দর ব্যবহারেও রয়েছে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা। পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে কিংবা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদের এই দুর্বলতাগুলো দূর করতে হবে। আমরা জানি, সারা বিশ্বে শ্রম-শোষণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় মজুরির মাধ্যমে। মজুরির সঙ্গে মুনাফার সম্পর্ক বিপরীত। মজুরি বাড়লে মুনাফা কমে, মজুরি কমলে মুনাফা বাড়ে। দেশে পোশাক খাতে যে পরিমাণ মুনাফা হয় আর অন্য কোনো খাতে তা হয় বলে বোধ করি না। দীর্ঘমেয়াদী অস্তিত্বের কথা মাথায় রাখতে হলে এ খাতের শ্রমিকদের স্বার্থের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ভিয়েতনামের টপকে যাওয়ার বিষয়টিতে উদ্বিগ্ন না হয়ে আমাদের লক্ষ রাখা প্রয়োজন, স্বাভাবিক সময়ে আমরা আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেতে পারব কিনা। সেক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের যথাযথ বাস্তবায়ন পরিস্থিতি সামাল দিতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।