যুক্তরাজ্যের বাজারে পণ্য ও সেবা রফতানি বাড়ানো এবং দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) চান বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা। বুধবার (১৯ আগস্ট) ঢাকা চেম্বার আয়োজিত ‘যুক্তরাজ্যের সাথে বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে এ দাবি জানান উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী ও খাতসংশ্লিষ্টরা। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন এবং যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম উপস্থিত ছিলেন। এ সময় বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস ও প্রয়োজনীয় নীতিমালা সংস্কারের পরামর্শ দেন। স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগকারী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাজ্যের অবস্থান দ্বিতীয়, যেখানে ২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশে ২.৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং প্রায় ২০০টি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে। তিনি জানান, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ ৩.৪৫ বিলিয়ন মূল্যের পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানি করে, যেখানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৪.৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে তিনি নতুন পণ্যের উদ্ভাবন এবং পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোরারোপ করেন। ঢাকা চেম্বারের সভাপতি বাংলাদেশের অবকাঠামোখাতে বৃহৎ প্রকল্পসমূহে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আকর্ষণে ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার বন্ড’ চালুর প্রস্তাব করেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিকে চলমান রাখা, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি এবং কোডিভ-পরবর্তী অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা আরো দীর্ঘ সময়ের জন্য বলবৎ রাখা একান্ত প্রয়োজন বলে জানান ডিসিসিআই সভাপতি। এসময় তিনি বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের মধ্যকার বাণিজ্য সম্প্রসারণে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের জন্য দুই দেশের সরকারের উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। ওয়েবিনার ডায়ালগে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সানেম’র নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান। বাংলাদেশে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ আরো বৃদ্ধিতে তিনি বাংলাদেশি রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ, যথাযথ নীতিমালা ও কৌশল প্রণয়ন, ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, দ্রুততম সময়ে অবকাঠামো এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের (এসইজেড) কার্যক্রম বাস্তবায়ন, খুবই জরুরি বলে জানান। এছাড়া সেলিম রায়হান বাংলাদেশ এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের লক্ষ্যে উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ২০২৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা নিয়ে পণ্য রফতানি করতে পারবে, যা আমাদের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক একটি বিষয়। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্কোন্নয়নে, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বিষয়ক ডায়ালগ আয়োজন, দু’দেশের বাণিজ্য সংগঠনসমূহের মধ্যে যোগাযোগ আরো সুদৃঢ়করণ, কোভিড উত্তর বাণিজ্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় ‘মার্কেট স্ট্রাটেজি’ প্রণয়ন এবং ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের আরো বেশি হারে বাংলাদেশে বিনিয়োগে উৎসাহী করার প্রস্তাব করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ তরুণ জনগোষ্ঠী তথ্য-প্রযুক্তিখাতে বেশ সম্ভাবনাময় এবং এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশ তথ্য-প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে, যা তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, পাশাপাশি আমাদের তরুণদের দক্ষতাও বাড়াবে। যুক্তরাজ্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাইদা মুনা তাসনিম বলেন, ব্রিটিশ বাণিজ্য সংগঠনসমূহ বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য খাত বিষয়ে খুব বেশি অবগত নয় এবং এ অবস্থা উত্তরণে বাংলাদেশের চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোকে যোগাযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ই-কমার্স বাজার রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশি তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। হাইকমিশনার বলেন, ব্রিটেনে হালাল পণ্য এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতে বিশাল বাজার রয়েছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা সহজেই এ সুযোগ গ্রহণ করে আরো বেশি হারে পণ্য যুক্তরাজ্যে রফতানি করতে পারে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ একান্ত আবশ্যক। তিনি জানান, বাংলাদেশের ওষুধ, তথ্যপ্রযুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেবা এবং আর্থিক খাতসমূহে ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া তিনি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণে বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস, প্রয়োজনীয় নীতিমালার সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। হাইকমিশনার বলেন, সম্প্রতি ব্রিটেনে ‘বাংলা বন্ড’ চালু হয়েছে, যা দু’দেশের উদ্যোক্তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি দু’দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশের ব্রিটিশ হাইকমিশন থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন। নির্ধারিত আলোচনায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (এফটিএ) শরীফা খান, ডিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ও ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ এর চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী, বেসিস’র সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবির, ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির এবং রহিমআফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিম অংশগ্রহণ করেন। প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে-এর চেয়ারম্যান এবং সিইও আহসান খান চৌধুরী ব্রিটেনে বাংলাদেশি পণ্য ও সেবা রফতানি বাজার সম্প্রসারণে দু’দেশের মধ্যকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষরের আহ্বান জানান। পাশাপাশি রফতানি পণ্যের বহুমুখীকরণ এবং বাংলাদেশি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো বেশি হারে লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে প্রবর্তিত ‘বাংলা বন্ড’-এ বিনিয়োগ করার প্রস্তাব করেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শরীফা খান জানান, ব্রিটিশ সরকার ২০২৭ পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা প্রদান করছে এবং বাংলাদেশি পণ্য রফতানিতে বিদ্যমান শুল্ক কাঠামোর বিষয়টি আলোচনাধীন। তিনি বলেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশি পণ্যের রফতানি বৃদ্ধির জন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি, পর্যটন, স্বাস্থ্য ও নার্সিং প্রভৃতি খাতে ব্রিটিশ বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। রহিমআফরোজ স্টোরেজ পাওয়ার বিজনেসের নির্বাহী পরিচালক ফারাজ এ রহিম, ব্রিটেনে লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের পণ্য রফতানির ওপর জোরারোপ করেন এবং বাংলাদেশে ব্রিটিশ বিনিয়োগ আকর্ষণে আমাদের স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাথে যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলোকে যৌথ বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ইনসেপটা ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুল মোক্তাদির ব্রিটেনে বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের নিবন্ধন পেতে সে দেশের এমএইচআরএ-এর সাথে বাংলাদেশি ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থার যোগাযোগ স্থাপনে বাংলাদেশস্থ ব্রিটেনের দূতাবাসকে সহযোগিতার আহ্বান জানান। তিনি জানান, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৪-৫ বিলিয়ন ব্রিটিশ পাউন্ডের জেনেরিক বাজার রয়েছে, যা আমাদের ফার্মাসিউটিক্যাল খাতের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। এছাড়াও তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং এবং বিজ্ঞান বিষয়ে বাংলাদেশের মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে ব্রিটিশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহের বাংলাদেশে শাখা ক্যাম্পাস খোলার প্রস্তাব করেন। বেসিস সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর বলেন, সফটওয়্যার এবং তথ্য-প্রযুক্তি সেবাখাতে গত বছর বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ ছিল ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং এখাতে পণ্য রফতানিতে যুক্তরাজ্যর অবস্থান দ্বিতীয়। তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট তৈরিতে নিয়োজিত যুক্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমাদের হাইটেক পার্কে বিনিয়োগের আহ্বান জানান, যার মাধ্যমে অভিজ্ঞতা বিনিময় বৃদ্ধি পাবে। ডিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ও আনোয়ার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসেন খালেদ বলেন, তৈরি পোশাকের বাইরে ব্রিটেনে বাংলাদেশি পণ্য রফতানির পরিমাণ মাত্র ৭% এবং এ অবস্থা উত্তরণে আমাদের পণ্যের বহুমুখীকরণের কোনো বিকল্প নেই। তিনি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় হ্রাস এবং ভ্যালু চেইন স্থাপনের প্রস্তাব করেন। হোসেন খালেদ বলেন, বাংলাদেশের সেবা খাতে ব্রিটিশ বিনিয়োগের যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে এবং এ লক্ষ্য পূরণে দু’দেশের উদ্যোক্তাদের যৌথ বিনিয়োগে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। আসিফ ইব্রাহীম বলেন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ব্রিটেনে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক রফতানির পরিমাণ ছিল ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যেটি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে ৩.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। তিনি জানান, শিগগিরই বাংলাদেশের দুটো পুঁজিবাজারই অটোমেশন কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের আহ্বান জানান।