রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের কর্মহীন ও দুস্থ শ্রমিকদের জন্য নতুন একটি প্রণোদনা প্যাকেজ আসছে। আপাতত দুই বছরের জন্য করা হচ্ছে এ প্যাকেজ। সফল হলে সরকার একে স্থায়ী নিরাপত্তা কার্যক্রমেও রূপ দিতে পারে। পুরো প্যাকেজের আকার হবে ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো, যা বাংলাদেশের ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা (প্রতি ইউরো ১০০ টাকা ৪৭ পয়সা ধরে)।
এই প্যাকেজের আওতায় সরকার ১০ লাখ শ্রমিককে মাসে ৩ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দিতে চায়। এতে তিন মাসে মোট খরচ হবে ৯০০ কোটি টাকা। নির্বাচিত শ্রমিকেরা তিন মাস ৩ হাজার করে সর্বোচ্চ ৯ হাজার টাকা পাবেন। তবে শ্রমিক যদি তিন মাসের মধ্যে আগের কারখানা বা নতুন কোনো কারখানায় চাকরি পেয়ে যান, তাহলে যে মাসে কাজে যোগ দেবেন, সেই মাস থেকে তিনি নগদ সহায়তা পাবেন না।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই প্যাকেজ বাস্তবায়নে নীতিমালা তৈরি করেছে, যা গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অনুমোদন করেছে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আজকালের মধ্যেই নীতিমালাটি প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে। বেসরকারি শিল্পমালিকদের সহায়তায় কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করবে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের শ্রম অধিদপ্তর। এতে অর্থায়ন করবে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও জার্মানি সরকার।বিজ্ঞাপন
শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ কে এম মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রজ্ঞাপন জারির অপেক্ষায়। কাজ শুরুর পর কোনো জটিলতা দেখা দিলে তা সংশোধন করা হবে।’
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রজ্ঞাপন জারি হলে আগামী সপ্তাহে বাস্তবায়ন বিষয়ে বৈঠক হবে। বাস্তবায়ন শুরু হতে মাসখানেক লাগতে পারে। নীতিমালায় প্যাকেজ সম্পর্কে বলা হয়েছে, গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি খাতের দুস্থ শ্রমিকদের জরুরি মানবিক সহায়তা দিতে সরকার এই সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নিয়েছে।
যাঁরা সহায়তা পাবে
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকাশিল্পের যেসব শ্রমিক এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোনো কারখানায় পে-রোল অনুযায়ী কর্মরত ছিলেন এবং কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত, অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত ও কাজ করতে অক্ষম, তাঁরা এই প্যাকেজের সহায়তা পাবেন।
যেসব শ্রমিক দুর্ঘটনার কারণে শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন ও শারীরিক অসুস্থতার কারণে কাজে ফিরতে পারছেন না এবং সন্তান জন্মদানকারী যেসব শ্রমিক প্রসূতি-কল্যাণ সুবিধাবঞ্চিত এবং পরে চাকরিতে বহাল নন, তাঁরাও টাকা পাবেন।
এ ছাড়া যেসব শ্রমিক সাময়িকভাবে চাকরি হারিয়েছেন, আইনানুগ ক্ষতিপূরণ পাওয়ার শর্তের আওতাভুক্ত নন, এখনো কর্মহীন; লে-অফকৃত ও ছাঁটাইকৃত হয়ে যাঁরা বেকার আছেন, লে-অফকৃত শ্রমিক যাঁরা এক বা দুই মাসের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন, কিন্তু এখনো কর্মহীন এবং এ বছরের ৮ মার্চের পর স্থায়ীভাবে কারখানা বন্ধের কারণে যাঁরা বেকার আছেন, তাঁরাও থাকবেন টাকা পাওয়ার তালিকায়।বিজ্ঞাপন
নির্বাচন ও টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া
কারখানাগুলোই প্রাথমিকভাবে উপকারভোগী শ্রমিকদের নির্বাচন করবে। তারা নির্বাচিত দুস্থ শ্রমিকের নাম, ঠিকানা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর, ব্যাংক বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) হিসাব নম্বর, মোবাইল ফোন নম্বরসহ বিস্তারিত তথ্য শিল্প সংগঠনে পাঠাবে। শিল্প সংগঠন তা পাঠাবে শ্রম অধিদপ্তরে।
এরপর শ্রম অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে গঠিতব্য ৮ সদস্যের বাস্তবায়ন কমিটি চূড়ান্ত তালিকা অনুমোদন করবে। তখন তালিকাটি প্রধান হিসাব কর্মকর্তার কার্যালয় হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক উপকারভোগী শ্রমিকদের ব্যাংক বা এমএফএস হিসাবে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেবে। এ জন্য শ্রমিকদের চার্জ বা মাশুল দিতে হবে না।
কেউ মিথ্যা তথ্য দিয়ে টাকা নিলে বা পাওয়ার যোগ্য নন এমন কেউ টাকা নিলে ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রম অধিদপ্তর তা বাতিল করবে এবং তা ফেরতযোগ্য হবে। শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিবের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের আরেকটি কমিটি এ কার্যক্রম নিয়মিত পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করবে।বিজ্ঞাপন
রপ্তানিমুখী’ শব্দটির কারণে আগেও অনেক শ্রমিক প্রণোদনার টাকা পাননি, এবারও তা-ই হবে। ফলে বাছাইপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। রপ্তানি আদেশ পাওয়া একটি কারখানা যখন অন্য কারখানায় ঠিকায় (সাব-কন্ট্রাক্ট) কাজ করায়, তখন এসব কারখানার শ্রমিকদের রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিক হিসেবে গোনায় ধরা হয় না।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার
টাকা আসবে কোথা থেকে
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই প্যাকেজ বাস্তবায়নে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) তার ‘টিম ইউরোপ’ নামের তহবিল থেকে ৯ কোটি ৩০ লাখ ইউরো, আর জার্মানি ২ কোটি ইউরো দেবে।
ইইউ বাংলাদেশকে ৩৩ কোটি ৪০ লাখ ইউরো দেওয়ার কথা জানায় গত মে মাসে। এর মধ্যে দেশের মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে ২৬ কোটি ৩০ লাখ ইউরো ও কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমিকদের জন্য ১১ কোটি ৩০ লাখ ইউরো দেবে।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি, বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন তালিকা তৈরির কাজ করছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রপ্তানিমুখী’ শব্দটির কারণে আগেও অনেক শ্রমিক প্রণোদনার টাকা পাননি, এবারও তা-ই হবে। ফলে বাছাইপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। রপ্তানি আদেশ পাওয়া একটি কারখানা যখন অন্য কারখানায় ঠিকায় (সাব-কন্ট্রাক্ট) কাজ করায়, তখন এসব কারখানার শ্রমিকদের রপ্তানিমুখী কারখানার শ্রমিক হিসেবে গোনায় ধরা হয় না। এ ছাড়া সমিতির সদস্য নন এমন কারখানার শ্রমিকেরাই বেশি বিপদে। বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত।