অচেনা সড়ক, অফিস, বাড়ি, রেস্তোরাঁ কিংবা হোটেল ইত্যাদি খুঁজে পেতে গুগল ম্যাপ বেশ জনপ্রিয়। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনেকের কাছেই বিষয়টা ডালভাতের মতো ব্যাপার। সেই ধারণাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলো নিয়ে একটি ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্র (সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্ট-সিইডি)।
ম্যাপড ইন বাংলাদেশ নামের ডিজিটাল মানচিত্রটির মাধ্যমে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোর সুনির্দিষ্ট অবস্থান ঠিকানাসহ জানা যাবে। তার পাশাপাশি কারখানাটি কবে স্থাপিত, তারা কী ধরনের পোশাক উৎপাদন করে, তাদের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ডের নাম, রপ্তানির গন্তব্য দেশ এবং নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যার তথ্য মিলবে।
কারখানার নিকটবর্তী হাসপাতাল বা ক্লিনিক এবং ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের দূরত্ব, ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বরও জানা যাবে। এ ছাড়া জানা যাবে কারখানাটির কী কী সনদ রয়েছে, কারখানাটি কারা পরিদর্শন করেছে এবং কারখানাটিতে ওয়ার্কার্স পার্টিসিপেশন কমিটি আছে কি না।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা উন্নয়ন কেন্দ্র (সিইডি) ‘ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি) ’ শীর্ষক প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৮ সালের শেষ দিকে এই ডিজিটাল মানচিত্রের কাজ শুরু করে। যদিও তার আগের বছরই প্রকল্পটির যাত্রা শুরু হয়। চলবে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। লডেস ফাউন্ডেশন ও নেদারল্যান্ডস সরকারের অর্থায়নে এবং তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন—বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সহায়তায় প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) থেকেও প্রকল্পটি সহায়তা পাচ্ছে। আর প্রকল্পটির সমন্বয়কারী হিসেবে আছে ব্র্যাক।
ডিজিটাল মানচিত্রে এখন পর্যন্ত গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের ৩ হাজার ১২২টি পোশাক কারখানার অবস্থান ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত সংযুক্ত হয়েছে। তার মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১ হাজার ৮৩৪ ও বিকেএমইএর সদস্য ৫০২টি কারখানা রয়েছে।
বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ—উভয় সংগঠনের সদস্য, এমন কারখানার সংখ্যা ২৪৩টি। তার বাইরে ৫৪৩টি কারখানা রয়েছে, যেগুলো কোনো সংগঠনের সদস্য নয়। সামনের দিনগুলোতে দেশের অন্যান্য জেলায় থাকা কারখানাগুলোও মানচিত্রে যুক্ত হবে। অবশ্য, ইপিজেডের ভেতরের কারখানার তথ্য সংযুক্ত করার বিষয়ে এখনো বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজা) অনুমতি পায়নি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইডি।
ডিজিটাল মানচিত্রের এই বিশাল কর্মযজ্ঞের শুরুর গল্প শোনালেন সিইডির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (রিসার্চ অ্যান্ড নলেজ ম্যানেজমেন্ট) ফারিয়া আহমদ। বললেন, তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত। তবে বিশাল এই খাতের প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্ত একটি নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে নেই। আবার বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য নয়, এমন কারখানার ভবিষ্যতের কথাও ভাবার সময় এসেছে। ফলে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত একটি প্ল্যাটফর্মে আনার জন্যই ডিজিটাল মানচিত্র করা হয়েছে।
জরিপের মাধ্যমে সরাসরি কারখানা থেকে আমরা প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করি। তারপর মানচিত্রে প্রকাশের আগে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও ডিআইএফইর তথ্যের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই ও বিচার–বিশ্লেষণ করি। পরবর্তী সময়ে উৎপাদনের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে এমন কারখানা ডিজিটাল মানচিত্রে সংযুক্ত করা হয়।
সিইডির জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক (রিসার্চ অ্যান্ড নলেজ ম্যানেজমেন্ট) ফারিয়া আহমদ
ডিজিটাল মানচিত্রের পুরো কাজটি করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইডির ২০-২৫ জন কর্মী। তাঁরা যখন ডিজিটাল মানচিত্রের কাজ শুরু করেন, তখন কারখানাগুলো পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ক্রেতাদের দুই জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নিয়ে চাপে ছিল। এ কারণে অনেক কারখানা বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত বাইরে প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করে। তখন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সহায়তায় কারখানাগুলোকে বোঝানো হয়। পরবর্তী সময়ে কারখানাগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রকল্পের কাজে সহায়তা করতে থাকে। এভাবেই কাজটি এগোতে থাকে।
ফারিয়া আহমদ বলেন, ‘জরিপের মাধ্যমে সরাসরি কারখানা থেকে আমরা প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করি। তারপর মানচিত্রে প্রকাশের আগে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও ডিআইএফইর তথ্যের সঙ্গে বিভিন্নভাবে যাচাই-বাছাই ও বিচার–বিশ্লেষণ করি। পরবর্তী সময়ে উৎপাদনের কমপক্ষে ৮০ শতাংশ রপ্তানি করে এমন কারখানা ডিজিটাল মানচিত্রে সংযুক্ত করা হয়। চট্টগ্রামের কিছু কারখানা এখনো মানচিত্রে যুক্ত করা বাকি। অন্যদিকে ইপিজেডের কারখানাগুলো যুক্ত করার অনুমতি আমরা পাইনি। করোনার কারণেও পুরো প্রক্রিয়াটি কিছুটা শ্লথ হয়েছে।’
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইডির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ডিজিটাল মানচিত্রে যুক্ত হওয়া ৩ হাজার ১২২ কারখানায় মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার। তার মধ্যে নারী শ্রমিক আছেন ১৪ লাখ ৫৯ হাজার। আর পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ ৫৫ হাজার। মোট শ্রমিকের মধ্যে ৫৮ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ হচ্ছে পুরুষ শ্রমিক।
ফারিয়া আহমদ আরও বলেন, পোশাক কারখানার ডিজিটাল মানচিত্রটি গুগল মানচিত্রের অনুরূপ। তাই এটি ব্যবহার করে ডিআইএফই, বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সহজেই থানাভিত্তিক পোশাক কারখানা চিহ্নিত করতে পারবে। কোনো শ্রমিক হঠাৎ অসুস্থ হলে তাৎক্ষণিকভাবে কারখানার নিকটবর্তী হাসপাতালের তথ্য-উপাত্ত পেতে সহযোগিতা করবে। দুর্ঘটনা ঘটলেও মানচিত্র থেকে বিভিন্ন তথ্যের মাধ্যমে সহায়তা মিলবে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইডির দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ডিজিটাল মানচিত্রে যুক্ত হওয়া ৩ হাজার ১২২ কারখানায় মোট শ্রমিকের সংখ্যা ২৫ লাখ ১৪ হাজার। তার মধ্যে নারী শ্রমিক আছেন ১৪ লাখ ৫৯ হাজার। আর পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ১০ লাখ ৫৫ হাজার। মোট শ্রমিকের মধ্যে ৫৮ শতাংশ নারী ও ৪২ শতাংশ হচ্ছে পুরুষ শ্রমিক।
তৈরি পোশাক কারখানার তথ্য ক্রমাগত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রতি মাসেই কিছু শ্রমিক অন্যত্র চাকরি নিয়ে চলে যান। আবার নতুন শ্রমিকও যোগ দেন। ফলে কারখানাগুলোর শ্রমিকের সংখ্যা হালনাগাদ করা না থাকলে এই খাতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে না। অন্যদিকে মাঝেমধ্যে নতুন ক্রেতাও খুঁজে পাচ্ছে কারখানাগুলো। ফলে শ্রমিকের সংখ্যাসহ ডিজিটাল মানচিত্রটির সব ধরনের তথ্য-উপাত্ত হালনাগাদ করা এবং ২০২১ সালের পর (প্রকল্পের মেয়াদ শেষে) পুরো প্রক্রিয়াটি কীভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, তা নিয়ে কাজ চলছে বলে জানায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সিইডি।