বৈশ্বিক মহামারী কভিড-১৯ বড় ধরনের আঘাত হানে দেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকের ওপর, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের (পিপিই) মতো নতুন কিছু পণ্য রফতানিতে সম্ভাবনাও নিয়ে আসে কভিড, বিশেষ করে ফেস মাস্ক রফতানির মাধ্যমে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নেয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেননি দেশের পোশাক খাতের রফতানিকারকরা।
কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোতে খুচরা বিক্রয়কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেলে স্থবির হয়ে যায় বাংলাদেশের রফতানিমুখী পোশাক কারখানার উৎপাদন। তবে এ সংকটের মধ্যে বিশ্বব্যাপী চাহিদা বেড়ে যায় ফেস মাস্কসহ ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর। যেহেতু বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে বৃহৎ পোশাক রফতানিকারক, সেহেতু এ বাজারের জন্য পিপিই উৎপাদন করে রফতানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করার একটি সম্ভাবনা ও সুযোগ আসে বাংলাদেশের সামনে। এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান পিপিই রফতানি করেছেও, যদিও তা প্রত্যাশার তুলনায় নগণ্য।
আউটারওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের মধ্যে দেশের অন্যতম পোশাক কারখানা স্নোটেক্স। কভিড-১৯ মহামারীতে দেশের রফতানিমুখী সব কারখানার মতো উৎপাদন সচল রাখা নিয়ে বিপাকে পড়ে যায় প্রতিষ্ঠানটি। তবে করোনা সংক্রমণের ব্যাপ্তি বাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই বিশ্ববাজারে পিপিইর চাহিদা বেড়ে গেলে কারখানা সচল রাখা ও পোশাক খাতে বিনিয়োগকে বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ গ্রহণ করে স্নোটেক্স। মাস্কসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় ক্রয়াদেশ পেয়ে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত ২৬ লাখ পিস মাস্ক রফতানিও করে স্নোটেক্স। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ চালানটি রফতানি হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। স্নোটেক্সের মতোই পিপিই রফতানির সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ ছিল দেশের রফতানিমুখী অন্যান্য পোশাক কারখানারও। যদিও তা কাজে লাগাতে পারছে না সবাই।
এখন পর্যন্ত মাস্ক ও পিপিই রফতানি করে এমন ৩৩টি প্রতিষ্ঠানের নাম জানা গেছে বিজিএমইএ সূত্রে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে স্নোটেক্স, ওনাস ডিজাইন, ওনাস গার্মেন্টস, এসকোয়ার, বেক্সিমকো, ডেকো, এপিএস, আদুরী, স্মার্টেক্স, আমান, মোহাম্মদী, টিম, কাপকেক, উর্মী, রোমো, গ্লোবাল নিটওয়্যার, হরাইজন ও বিডবডি।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মতো বাজারে পিপিই রফতানির এ সুযোগ ভালোভাবেই গ্রহণ করেছে পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ চীন, ভিয়েতনাম ও শ্রীলংকা। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্যভাণ্ডার ইউএনকমট্রেড এবং মার্কিন ট্রেড কমিশন আইটিসির তথ্য বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত মাস্ক রফতানিতে সবচেয়ে এগিয়ে থাকা দেশটি হলো চীন। এই তিনটি বাজারে ২০১৯ সালের জানুয়ারি-জুন সময়ের তুলনায় চলতি বছরের একই সময়ে চীনের মাস্ক রফতানি বেড়েছে ৭০০ শতাংশের বেশি। একই সময়ে শ্রীলংকা থেকে মাস্ক রফতানি বেড়েছে প্রায় ৭০০ শতাংশ এবং ভিয়েতমানের রফতানি বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ারও বেড়েছে প্রায় ১৫০ শতাংশ। এক্ষেত্রে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ সময়ে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানে বাংলাদেশের রফতানি বেড়েছে ১০০ শতাংশের কিছু বেশি।
ইউএনকমট্রেড ও মার্কিন ট্রেড কমিশন আইটিসি বলছে, কভিড-১৯-এর প্রভাবে এশিয়ার প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে পোশাক আমদানি নাটকীয়ভাবে কমেছে। এর বিপরীতে ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে মাস্কের। বৈশ্বিক চাহিদা মেটাতে অনেক কারখানা মাস্ক উৎপাদনে এগিয়ে এসেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইইউ, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি ডলারের টেক্সটাইল ও সার্জিক্যাল মাস্ক আমদানি করেছে চীন থেকে। একই সময়ে এই তিন বাজারে ভিয়েতনাম রফতানি করেছে ৯৯ কোটি ৯০ লাখ ডলারের টেক্সটাইল ও সার্জিক্যাল মাস্ক।
এদিকে রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যের ভিত্তিতে বিজিএমইএ জানিয়েছে, চলতি বছর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশে তৈরি মাস্ক রফতানি হয়েছে ২ কোটি ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ডলারের। আর ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি হয় ২ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজার ডলারের। গত অর্থবছর সার্জিক্যাল মাস্ক রফতানি হয়েছে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার ডলারের। মাস্ক ও অন্যান্যসহ গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে মোট ৫০ কোটি ১০ লাখ ৪০ হাজার ডলারের পিপিই রফতানি হয়।
এরই মধ্যে মাস্ক ও পিপিই রফতানি করেছেন এমন উদ্যোক্তারা বলছেন, মানসম্পন্ন মাস্ক ও পিপিই তৈরি ও এর রফতানি মান নিশ্চিত করতে নতুন বিনিয়োগ করতে হয় উদ্যোক্তাদের। কিন্তু বর্তমানে যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে তা টেকসই হবে কিনা তা নিয়ে সন্দিহান উদ্যোক্তারা। ভ্যাকসিন আবিষ্কার হলেই যদি মাস্ক ও পিপিইর চাহিদা পতন হয় তাহলে বিনিয়োগ বোঝা হয়ে উঠতে পারে বলেও আশঙ্কা রয়েছে উদ্যোক্তাদের। মূলত এ দোলাচলের কারণে মাস্ক ও পিপিপি তৈরিতে বিনিয়োগে সতর্কভাবে এগোচ্ছেন প্রধান রফতানিকারকরা, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে রফতানির তুলনামূলক অবস্থানে।
স্নোটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়মিত বা প্রচলিত পোশাকের জন্য যে বিনিয়োগ করা হচ্ছে বা হবে তা আগামী ২০ থেকে ৩০ বছর ধরে কাজে আসবে। এখন মাস্ক ও পিপিইর জন্যও নতুন বিনিয়োগ করতে হবে। কিন্তু এসব পণ্যের চাহিদা টেকসই হবে কিনা তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এ প্রেক্ষাপটে মাস্ক ও পিপিইর স্বল্পমেয়াদি চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারক সংশ্লিষ্ট শিল্প মালিক সংগঠন বিজিএমইএ বলছে, রফতানি পণ্যের বৈচিত্র্যের প্রেক্ষাপটে মাস্কসহ বাংলাদেশের সম্ভাবনার বিষয়টি স্পষ্ট। ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশের পিপিই রফতানি ২৫ কোটি ২০ লাখ ডলার থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০ কোটি ১০ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। অন্যদিকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টারের (আইটিসি) তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে গোটা বিশ্বের পিপিই আমদানির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ১৬০ কোটি ডলার। অর্থাৎ কভিড-১৯ প্রেক্ষাপটে বৈশ্বিক চাহিদা বৃদ্ধি বিবেচনায় আমাদের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। এর জন্য সক্ষমতা গড়ে তোলাসহ প্রয়োজন নীতিগত সহায়তা।
বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, মাস্ক ও পিপিইর বাজার ধরতে আমাদের বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন। মেডিকেলের কাজে ব্যবহূত মাস্ক ও পিপিইর ভিন্ন গ্রেড রয়েছে, এক্ষেত্রে কঠোর কারিগরি দক্ষতার পাশাপাশি মানের ক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স বজায় রাখতে হয়। পিপিই-সংক্রান্ত ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে সঠিক বিনিয়োগ করার জন্য বিশেষ কারিগরি জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। পিপিইর কাঁচামালের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা বেশ দুরূহ, কাজেই কৌশলগত জোটবদ্ধতা ও প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ জরুরি।
ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজে সক্ষমতা গড়ে তোলা পর্যন্ত আমাদের কাঁচামাল সংগ্রহের সবচেয়ে কার্যকর উৎস ও তার দাম নিয়ে কাজ করতে হবে জানিয়ে রুবানা হক বলেন, যেহেতু পণ্যটি আমাদের জন্য প্রচলিত না, এখানে বিনিয়োগ আকর্ষণে বিশেষ প্রণোদনার পাশাপাশি রফতানিকারকদের জন্য আগ্রাসী বিপণন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আবার কাঁচামাল আমদানি ও দেশীয় বাজারে বিক্রির জন্য শুল্কমুক্ত সহায়তাসহ নীতিসহায়তার প্রয়োজন। যেগুলো ব্যবহার করে মেডিকেল গ্রেডের পিপিই-সংক্রান্ত কারখানা স্থাপন ও যথাযথ কর্তৃপক্ষ থেকে লাইসেন্স পাওয়া যায়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা বলছেন, মাস্কসহ অন্যান্য পিপিই রফতানির ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো পণ্যের দাম। আর পিপিই রফতানির সঠিক পরিসংখ্যানও উঠে আসছে না বলে সন্দেহ প্রকাশ করে তারা বলছেন, নিট পোশাক পণ্যের মধ্যে অনেক ধরনের মাস্ক রফতানি হতে পারে যার পরিমাণ নিশ্চিত করে বলা সম্ভব না। ফলে মাস্ক ও অন্যান্য পিপিই রফতানি আরো বেশিও হতে পারে।
ইপিবি ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান বণিক বার্তাকে বলেন, পিপিইর মধ্যে বিশেষ করে মাস্ক রফতানির প্রধান চ্যালেঞ্জ এ মুহূর্তে পণ্যটির দাম। গত কয়েক মাসে ব্যাপক হারে মাস্কের দাম হ্রাস পেয়েছে। মাস্ক ও পিপিই রফতানি সম্ভাবনা কাজে লাগাতে সরকারের বিশেষ প্রণোদনা দেয়ার বিষয়টিও চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অচিরেই এ পণ্যের বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান আরো শক্তিশালী হবে বলে আশা করছি।