পোশাক কারখানার নারী কর্মীদের যথাযথ মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে কারখানায় তাঁদের অনুপস্থিতি বাড়ে। মাসিকের জন্য গড়ে ২–৩ দিনের অনুপস্থিতিতে ২০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। এ কারণে বছরে কারখানায় উৎপাদন কমে হাজার হাজার কোটি টাকা। তাই মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভেঙে সচেতনতা বাড়াতে নারীর পাশাপাশি পুরুষ সহকর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ২১ অক্টোবর এসএনভি–প্রথম আলোর ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। তাঁরা বলেন, মাসিক নিয়ে অসচেতনতা ও ট্যাবুর কারণে পোশাক কারখানার নারী কর্মীরা দীর্ঘমেয়াদি প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে পড়ছেন। বেশির ভাগই স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। বক্তারা নারী কর্মীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় কারখানা কর্তৃপক্ষকে ভুর্তকি বা বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ এবং সরকারি–বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছেন। নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায় পরিচালিত এসএনভি বাংলাদেশের ওয়ার্কিং উইথ ওমেন প্রকল্প-২ এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে ‘পোশাক খাতে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা’ শিরোনামে ৬ পর্বের ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভার দ্বিতীয় পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে বক্তারা কথা বলেন পোশাক কারখানায় মাসিককালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে। নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এবং ওয়েভ আওয়ার ফিউচার ফাউন্ডেশনের সহায়তায় এসএনভি বাংলাদেশ মোট ১১টি কারখানায় প্রায় ১৫ হাজার নারী পোশাককর্মীর মধ্যে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি স্বল্পমূল্যে এ–সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় উপকরণ পৌঁছে দিচ্ছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে রেনেসাঁ গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক (মানবসম্পদ বিভাগ) সৈয়দা শায়লা আশরাফ বলেন, মাসিক নিয়ে আগে কখনো আলোচনাই করা হতো না। লক্ষ করা গেল যে সঠিকভাবে মাসিককালীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নিয়মনীতি অনুসরণ না করার ফলে মেয়েরা নির্দিষ্ট সময়ে অসুস্থ হতে থাকেন এবং কারখানায় অনুপস্থিতির হার বাড়তে থাকে। এতে কারখানার উৎপাদন কমে যেত। ধীরে ধীরে মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ হতে থােক। এসএনভিসহ অন্যান্য প্রকল্প এবং আমাদের ডাক্তারদের মাধ্যমে কারখানায় এ ব্যাপারে মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হলো। কারখানায় ডাক্তারের কক্ষে একটি নির্দিষ্ট কর্নারে খুবই স্বল্পমূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন সরবরাহ করা হয়। এতে কিছুটা অসুস্থতা কমে এলেও আমাদের আরও অনেক দূর যেতে হবে। ১২ বছর ধরে কারখানার নারী শ্রমিকদের দ্বারা পোশাকের পরিত্যক্ত কাপড় বা ঝুট দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত প্যাড তৈরির কাজ করছে এলা প্যাড। এর প্রতিষ্ঠাতা মামুনুর রহমান বলেন, ‘কাজ করতে গিয়ে দেখতে পাই, কারখানার মেয়েরা মাসে গড়ে ২–৩ দিন অনুপস্থিত থাকেন। দেশে ৩০ লাখ নারী শ্রমিকের হিসাব ধরলে এই ২–৩ দিনে ২০ কোটি কর্মঘণ্টা হারাচ্ছি আমরা। একমাত্র স্যানিটারি ন্যাপকিন নিশ্চিত করতে না পারার কারণে এ বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে। মাসিক নিয়ে ট্যাবু ভাঙাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’ তিনি শ্রম আইনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বিষয়টি যুক্ত করার আহ্বান জানান। স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের হেড অব মার্কেটিং জেসমিন জামান ট্যাবুর বিষয়টি তুলে ধরে বলেন, ১৯৯৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠান দেশে প্রথম ‘সেনোরা’ নামে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি শুরু করে। তখন স্যানিটারি ন্যাপকিন কিংবা মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে েতমন আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, স্কয়ার শুধু পোশাক কারখানার নারী কর্মীদের জন্য স্বল্পমূল্যের উন্নত মানের প্যাড ‘ফেমিনা’ তৈরি করছে। সেনোরার লাভ থেকে এই প্যাড তৈরিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। ২০১৬ সালে এসএনভি বাংলাদেশের সঙ্গে স্কয়ার ‘গো বাংলাদেশ’ প্রকল্পে কাজ করার সময় লক্ষ করা গিয়েছিল প্যাডের মাধ্যমে মাসিক ব্যবস্থাপনার কারণে কারখানায় ৬ শতাংশ অনুপস্থিতি কমে গিয়েছিল। উৎপাদন বেড়েছিল ২–৩ শতাংশ। কর্মীদের জন্য বিনা মূল্যে প্রশিক্ষণ, প্যাড দেওয়াসহ যেকোনো ধরনের কাজ করতে স্কয়ার প্রস্তুত রয়েছে। নারীর পাশাপািশ পুরুষ সহকর্মীদেরও সচেতন করতে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও অন্যদের উদ্যোগী হতে হবে। পুরুষ সহকর্মীদের সচেতনতার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে অচান রিটেল ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক কমপ্লায়েন্স ব্যবস্থাপক সাইফুল আলম মল্লিক বলেন, ট্যাবু ভাঙা ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য তাঁরা প্রশিক্ষণে নারীর পাশাপাশি পুরুষ সহকর্মীদেরও প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। যাতে এই পুরুষেরা তাঁদের নারী সহকর্মীদের প্রতি সচেতন হওয়ার পাশাপাশি বাড়িতে তাঁদের মা, বোন ও স্ত্রীকে সুরক্ষা দিতে পারেন। আশা করা যায়, এই কর্মীরা একসময় মাসিক ব্যবস্থাপনার সুদূরপ্রসারী উপকারিতা উপলব্ধি করতে পারবেন। মাসিক নিয়ে যে ট্যাবু আছে, তা ভেঙে যাবে। তিনি বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের ওয়েভ আওয়ার ফিউচার ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিন বছর মেয়াদে এসএনভির সহায়তায় আটটি কারখানায় প্রায় ছয় হাজার নারী কর্মীকে ভর্তুকিতে স্বল্প মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে। কোনো কোনো কারখানা বিনা মূল্যেও স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছে নারী কর্মীদের। তিনি বলেন, পোশাক কারখানার ৮০ শতাংশই নারী শ্রমিক। তাই এ খাতের নারীদের সুরক্ষায় সরকারি–বেসরকারি এবং কারখানার মালিকদের পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। তিনি বলেন, পোশাক কারখানা দেশের অর্থনীতির প্রাণ। আর পোশাক কারখানার প্রাণ নারী কর্মীরা। তাই এ খাতের নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের আরও বেশি উদ্যোগী হওয়া দরকার।