কোভিড-১৯ সঙ্কটে পোশাক শিল্প বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে জানিয়ে এ শিল্পের সুরক্ষায় নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ আরো বাড়ানো এবং নতুন সহায়তার দাবি জানিয়েছে পোশাক কারখানার মালিকেরা। সোমবার এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমএইর সভাপতি ড. রুবানা হক। এ সময় তিনি করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতিতে পোশাক খাতের ক্ষয়ক্ষতি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, কারখানায় শ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তায় নেয়া পদক্ষেপসহ নানা বিষয়ে লিখিত বক্তব্যে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞাতা জানিয়ে রুবানা হক বলেন, এ শিল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এতে শ্রমিদের মজুরি দেয়া সম্ভব হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহযোগিতায় এ শিল্প ঘুরে দাঁড়িয়েছে। করোনা পোশাক শিল্পে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পরিণাম আরও ভয়াবহ হতো। কিন্তু আমরা ষ্টেকহোল্ডারদের ক্রয়াদেশ বাতিল ইস্যুতে সোচ্চার ছিলাম। ক্রেতাদের সাথে দর কষাকষি করেছি। ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ বাতিলের ফলে সৃষ্ট শিল্পের দুর্দশা ও চ্যালেঞ্জগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরেছি। এ কারণে বড় ক্ষতি থেকে রেহাই পাওয়া গেছে। রুবানা হক বলেন, ব্যবসা পরিস্থিতি, বিশেষ করে ক্রয়াদেশ বাতিলের তথ্য পেতে আমরা ১৯ মার্চ একটি অনলাইন পোর্টাল খুলি, যেখানে সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিতের তথ্য প্রদান করেছেন। এপ্রিলের শেষ নাগাদ ১১৫০টি সদস্য প্রতিষ্ঠান এ পোর্টালে ৩ দমমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের কার্যাদেশ বাতিল ও স্থগিতের তথ্য প্রদান করেন, যার মাধ্যমে ৬৫টি দেশের প্রায় ১৩০০টি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ বাতিলের তথ্য পাওয়া যায়। মাল্টি-স্টেকহোল্ডার এপ্রোচের ভিত্তিতে বিজিএমইএর ক্রমাগত যোগাযোগ এবং চাপ সৃষ্টির ফলে জুন-আগষ্ট সময়ে বাতিলকৃত ক্রয়াদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ পুনর্বহাল সম্ভব হয়। যদিও কারখানাগুলোকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। মূল্যছাড় ও ডেফার্ড পেমেন্ট মেনে নিতে হয়েছে। প্রতিটি পদক্ষেপই ছিলো ক্রেতাদের সাথে আস্থার সম্পর্ক ধরে রাখা। এছাড়া আইএলও’কে সম্পৃক্ত করে ক্রেতাদেরকে নির্বিচারে ক্রয়াদেশ বাতিল এবং ডিসকাউন্টসহ অন্যান্য অনৈতিক আচরণ থেকে বিরত রাখার জন্যও আহবান জানানো হয়েছিল।
“ক্রেতাদের সাথে আলোচনা করে আমরা পোশাক শ্রমিকদের জন্য একটি তহবিল গঠনের বিষয়ে জার্মানী ও ইউরোপিয় ইউনিয়নকেও আহ্বান জানাই। এর পরপরই জার্মানি বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য ২০ মিলিয়ন ইউরো বেকার তহবিল গঠনে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।” লিখিত বক্তব্যে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের সংক্রমণ পরীক্ষায় গাজীপুরের চন্দ্রায় বিশ্বমানের পিসিআর ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। এ ল্যাবে প্রতি শিফটে ১৮০টি পর্যন্ত স্যাম্পল পরীক্ষা করা যায়। ১৬ জন কর্মী এখানে কাজ করছে। তাছাড়া, সাভার ও মিরপুরে কোভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহের জন্য ২টি বুথ আছে। শ্রমিকেরা সেখানে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করাতে পারছে। শ্রমিকদের জন্য আইসোলেশন/কোয়ারেন্টাইন সেন্টার খোলা হয়েছে। চট্টগ্রামে শ্রমিকদের করোনা চিকিৎসা সেবা দিতে ৫০ শয্যা বিশিষ্ট কোভিড ফিল্ড হাসাপাতাল চালু করা হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও এর বিস্তার রোধকল্পে এবং শ্রমিকদেরকে চিকিৎসা দিতে বিজিএমইএ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মায়া এবং কমন হেলথ এর সাথে উদ্যোগ নিয়েছে। রুবানা হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে করোনার প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছি, তবে এর অভিঘাত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারি নাই। প্রধান বাজারগুলোতে জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও অক্টোবর ও নভেম্বরে আবারও কমেছে, যা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব হিসেবে দেখছি। এ সময় তিনি পোশাকশিল্পে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব ও সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ তুলে ধরেন।
রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে মন্দা
করোনার প্রাদুর্ভাবে চলতি বছরের মার্চ-জুলাই পর্যন্ত তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানিতে সামান্য প্রবৃদ্ধি হলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আবার হুমকির মুখে পড়েছে। অক্টোবরে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি কমেছে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। নভেম্বরের ১ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত রপ্তানি কমেছে ৬ শতাংশ, যা এই শিল্পের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রধান বাজারগুলোতে জুলাই, আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে রপ্তানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও অক্টোবর মাসে আবারও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। অক্টোবরে গত বছরের তুলনায় প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্স, ইতালি ও জাপানে পোশাক রপ্তানি কমেছে যথাক্রমে ৮ শতাংশ, ১০ শতাংশ, ৬ শতাংশ, ১৫ শতাংশ, ৩০ শতাংশ এবং ২৮ শতাংশ।
পোশাকের খুচরা বিক্রয় ও চাহিদাতে ধ্বস
করোনা মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে লকডাউনের কারণে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই পোশাকের খুচরা বিক্রয়ে ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে লকডাউনের কারণে খুচরা বিক্রয় ইতিমধ্যে কমতে শুরু করেছে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমছে। যার প্রভাবে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানি মুল্য উভয়ই কমছে। গত কয়েক মাসে ইউরোপে খুচরা বিক্রয় কিছুটা কমে আগষ্ট যথাক্রমে ৫ শতাংশ হয়, যা সেপ্টেম্বরে ইউরোপে বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশ।
পোশাকের নজিরবিহীন দরপতন
করোনা প্রাদুর্ভাবের আগে থেকেই পোশাকের দরপতন শুরু হতে থাকে। যা করোনার পরে তীব্র আকার ধারণ করে। ২০১৪-২০১৯ এই ৫ বছরে পোশাক রপ্তানি মুল্য হারিয়েছে গড়ে বছরে প্রায় ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গত সেপ্টেম্বরে সারা পৃথিবীতে পোশাকের দরপতন হয় ৫ দমমিক ২৩ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই দরপতন ছিল ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। দর পতনের এই ঋণাত্মক ধারা অব্যাহত রেখে বিশ্ব বাজারে পোশাকের দরপতন হয়েছে অক্টোবর মাসে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং নভেম্বরের ১ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত হয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। তিনি বলেন, পোশাক রপ্তানির এই সার্বিক পরিস্থিতিই বলে দিচ্ছে- এ শিল্পের আকাশে মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এর জন্য এখনই প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করা আমাদের একার (উদ্যোক্তাদের) পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে আমাদের সম্পৃক্ততা ও চাপ অব্যাহত রেখেছি। তারপরও শিল্পের সুরক্ষায় এ মূহুর্তে নীতি সহায়তা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বিশেষ করে, সরকার প্রদত্ত প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজন সাপেক্ষে নতুন সহায়তা প্রদান শিল্পের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বিজিএমইএ সভাপতি আরো জানান, বিশ্ব বাজারে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এতে শেয়ার মাত্র ৬ দশমিক ৮ শতাংশ। এ বাজারে আরও অংশ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। যদিও ভিয়েতনামকে আমাদের মূল প্রতিযোগী হিসেবে দেখা হয়, বাস্তবতা হলো- রাতারাতি তাদের পক্ষে সামর্থ্য বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাছাড়া, পোশাক পণ্য ভিয়েতনামের প্রধান রপ্তানি পণ্যও নয়। এছাড়া কম্বোডিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধা হারিয়েছে। ইথিওপিয়ায় সংঘটিত অস্থিতিশীলতা তাদের শিল্প ও অর্থনীতিকে হূমকির মুখে ফেলেছে। এগুলোর বিপরীতে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে বিভিন্ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে বলা যায় এই দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারলে আগামিতে পোশাক শিল্পের রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তাই সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ, অনুগ্রহ করে শিল্পের জন্য যে প্রনোদনা প্যাকেজটি দিয়েছেন, তার মেয়াদ বাড়িয়ে দিন। একইসাথে প্রয়োজনে নতুন সহায়তা দেয়া যায় কিনা তা সহানুভূতির সাথে বিবেচনার অনুরোধও জানান এই পোশাক কারখানা মালিক।