Home বাংলা নিউজ দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে

দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে

বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে সব সময়ই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪২.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্র মোতাবেক, গত এক বছরে রিজার্ভ বেড়েছে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ৩২.১১ বিলিয়ন ডলার। এক বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে ৪২.০৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেকর্ড গড়েছে। খুব দ্রুতই বাংলাদেশের রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন অতিক্রম করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। করোনার এই সংকটময় পরিস্থিতিতেও প্রবাসী আয়ের রেকর্ডের খবরটা নিশ্চয়ই ইতিবাচক। বিশ্বব্যাংক বলছে, এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২১ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। তবে সম্প্রতি কর্মী পাঠানোর বিষয়ে নানামুখী সংকট আমাদের সামনে এসেছে। প্রশ্ন উঠেছে দক্ষ শ্রমিক নিয়ে। যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি এখনো অদক্ষই। সংগত কারণেই গত ১৮ ডিসেম্বর পালিত আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের স্লোগানটা হলো ‘মুজিব বর্ষের আহ্বান, দক্ষ হয়ে বিদেশে যান’।

গত ১৯ ডিসেম্বর কালের কণ্ঠে প্রকাশিত ‘প্রয়োজন দক্ষ অভিবাসী কর্মী’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে দক্ষ শ্রমিক প্রসঙ্গে বিস্তর যুক্তি ও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। উক্ত সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, প্রতিবছর ৭ লাখ থেকে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতেন, সেখানে করোনার কারণে ২৯ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম কর্মী বিভিন্ন দেশে যেতে পেরেছেন। কর্মী যাওয়ার সংখ্যা শুধু নয়, বিদেশ থেকে কর্মী ফেরত আসার সংখ্যাটাও অন্য বছরের চেয়ে কয়েক গুণে বেড়েছে। করোনার কারণে এপ্রিলে বিদেশে লোক পাঠানো প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, স্বাভাবিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এপ্রিল থেকে ১২ ডিসেম্বর এই সময়ে তিন লাখ ৬০ হাজার কর্মী বিদেশ থেকে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৪ হাজারই আবার নারী কর্মী। এমন খবর আমাদের জন্য নিশ্চয়ই হতাশার। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির কারণগুলোর মধ্যে প্রধান হিসেবে প্রবাসী আয়কে বিবেচনা করা হয়। কাঁচামাল আমদানির খরচ বাদ দিলে তৈরি পোশাক খাতের চেয়ে তিন গুণ বেশি নিট বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স থেকে। কাজেই বিদেশে কর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে সংকট তৈরি হলে তা দেশের অর্থনীতির ওপরই আঘাত হানবে এবং এটি আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

তবে এ কথা সত্য যে আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের বাস্তবতায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা তুলনামূলকভাবে অদক্ষ। বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় শিক্ষিত ও দক্ষতাসম্পন্নদের কদর বেশি। এ কারণে আমাদের দেশের কর্মীরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় ভালো কর্মসংস্থান অর্জন করতে পারছেন না; এমনকি ভালো ও বেশি আয়ের পেশায় বাংলাদেশিদের নিয়োগও যথেষ্ট কম। ফলে সংগত কারণেই দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানোর দিকে সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে।

প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, সরকার প্রতি উপজেলা থেকে বছরে গড়ে এক হাজার কর্মী বিদেশে পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে। এটি আমাদের জন্য আশার কথা। সব কর্মক্ষেত্র সবার জন্য উন্মুক্ত না হলেও দক্ষ জনশক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে দক্ষতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে বলে ধারণা করা যায়।

প্রসংগত উল্লেখ করতে চাই, জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) প্রকাশিত গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স-২০২০ অনুযায়ী ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। অন্যদিকে ৩৫.৯ স্কোর নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শেষে রয়েছে বাংলাদেশ। এটি দেশের শিক্ষা, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের দৈন্যদশাই নির্দেশ করে। কিন্তু কেন বৈশ্বিক তালিকার তলানিতে বাংলাদেশ—এমন প্রশ্ন আমাদের সামনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সূচকটি তৈরি করতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনসহ সাতটি বিষয়কে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। সংগত কারণেই বিদেশে শ্রমিক নিয়োগ এবং আমাদের দেশে দক্ষ জনশক্তি তৈরির প্রসঙ্গের সঙ্গে এর একটি কার্যকরণ সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। যেহেতু শিক্ষা, প্রযুক্তি, উদ্ভাবনসহ বেশ কিছু দক্ষতার বিষয়ে এই সূচকটি দাঁড় করানো হয়েছে, সেহেতু এর সঙ্গে বিদেশে শ্রমিক নিয়োগ ও দক্ষ জনবলের প্রশ্নটি আমাদের সামনে আরো জোরালোভাবে এসেছে।

বিদেশফেরত বাংলাদেশিরা এখন আছেন নানা সংকটে। সরকার অবশ্য এরই মধ্যে দেশে তাদের আর্থ-সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার কারণে ফেরত আসা প্রত্যাগত শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ৪ শতাংশ সুদে এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ নিতে পারবেন। তবে নানা জটিলতায় এই তহবিল থেকে প্রবাসী কর্মীরা খুব বেশি সহায়তা পাচ্ছেন না বলে জানা গেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের ফান্ড আরো বেশি করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

সার্বিকভাবে বলা যেতে পারে, কভিডের অভিঘাত থেকে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে অভিবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি জরুরি দেশে ফেরত আসা অভিবাসীদের দেশীয় অর্থনীতিতে সম্পৃক্ত করা। রেমিট্যান্সের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে হলে বৈধ পথে যাতে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহী হন, সে জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করতে হবে। এ ছাড়া দেশে আটকে পড়া প্রবাসীদের আবার ফেরত পাঠাতে এবং প্রবাসে থাকা অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানো বন্ধ করতে দ্বিপক্ষীয় কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার কোনো বিকল্প নেই।

অভিবাসনপ্রক্রিয়া মেনে যাঁরা বিদেশে গেছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান; কিন্তু সরকারের গৃহীত বিভিন্ন ব্যবস্থা সম্পর্কে না জেনেও বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকে এবং তাঁদের সংখ্যাই বেশি। শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যেমন ঘটেছে, তেমনি বেঁচে আছে তাঁদের ওপর নির্ভরশীল লাখ লাখ পরিবার। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই শ্রমিকদের অভিবাসনপ্রক্রিয়াকে এখনো নিরাপদ করা যায়নি। এখনো অবসান হয়নি তাঁদের দুর্ভোগ ও বঞ্চনার। আর এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে আমাদের সামনে এসেছে দক্ষ জনশক্তির সংকট। কাজেই দক্ষ জনশক্তি যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিদেশে পাঠাতে পারলে আমাদের দেশের অর্থনীতি ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠবে—এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here