দেশের রফতানিমুখী পোশাক শিল্পে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিশ্ববাজারে নভেম্বরে পোশাক রফতানি ৬ শতাংশ ও মূল্য কমেছে প্রায় ৫ শতাংশ। এমন তথ্য তুলে ধরে সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। ওই প্রতিবেদনে করোনার প্রথম ধাক্কায় সরকারের দেয়া প্রণোদনা ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে বাড়িয়ে ৬০ মাস নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। এদিকে, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত রফতানি খাতের শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো সিদ্ধান্ত নিচ্ছে না। এ বিষয়ে খুব শিগগিরই অর্থমন্ত্রী দিকনির্দেশনা চাইবেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এরপর ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে অর্থ মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। করোনায় রফতানি খাতে সরকারের ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ প্যাকেজ থেকে এপ্রিল-জুনে ৩৫ লাখ পোশাক কর্মীকে বেতন দেয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় চলতি বাজেট থেকে এ সহায়তা প্রদান করে। তবে শর্ত ছিল এ ঋণ ১৮ মাসে পরিশোধ করতে হবে। আর এর গ্রেস পিরিয়ড হবে ৬ মাস। করোনার দ্বিতীয় ঢেউর প্রসঙ্গে তুলে ধরে বিজিএমইএ এ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বিজিএমইএর প্রস্তাবের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা চাওয়া হবে। তিনি যে নির্দেশনা দেবেন সেভাবে অর্থ বিভাগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আলোচনা করবেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। তবে বর্তমানে ফলোআপ চিকিৎসার জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। দেশে ফিরে এ বিষয়টি নিয়ে তিনি আলোচনা করতে পারেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র ধারণা দিয়েছে। বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. হাতেম যুগান্তরকে বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউর আলামত পেয়ে অনেক বিদেশি ক্রেতা আবারও অর্ডার স্লো করে দিয়েছেন। অনেকে স্থগিতও করছেন। কিছু অর্ডার আসার কথা ছিল সেগুলো আর দিচ্ছেন না বায়াররা। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের প্রণোদনা প্যাকেজের ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধের মেয়াদ ও গ্রেস পিরিয়ড বাড়ানোর যৌক্তিকতা রয়েছে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে দেয়া বিজিএমইএর প্রতিবেদনে দ্বিতীয় ঢেউর মুখোমুখি হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিজিএমইএর প্রেসিডেন্ট ড. রুবানা হক। প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে সৃষ্ট সংকট থেকে শিল্প যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল, ঠিক তখনই দ্বিতীয় ঢেউয়ের অশনিসংকেত দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আর এতে আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল তা এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে হুমকির মধ্যে পড়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে অক্টোবরে ৬টি প্রধান দেশে পোশাক রফতানি কমেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমেছে ৮ শতাংশ, জার্মানিতে ১০ শতাংশ, স্পেনে ৬ শতাংশ, ফ্রান্সে ১৫ শতাংশ, ইতালিতে ৩০ শতাংশ ও জাপানে ২৮ শতাংশ। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ ৩ মাস প্রধান রফতানির বাজারে পোশাক রফতানি কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু অক্টোবরে এসে আবারও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পায়। এটিকে আমরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব হিসেবে দেখছি। তবে করোনার প্রথম ধাক্কায় মার্চ থেকে জুলাই এ সময়ে তৈরি পোশাক রফতানি কমেছিল ৩৪ দশমিক ৭২ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে বিশ্ববাজারে অক্টোবর ও নভেম্বরে আরও পোশাকের খুচরা বিক্রয় মূল্য ও চাহিদার বড় ধরনের পতন ঘটেছে। এর নেতিবাচক প্রভাবে দেশের পোশাক শিল্পের রফতানির প্রবৃদ্ধি ও মূল্য উভয় কমেছে। এর আগেও করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী লকডাউনের কারণে ফেব্রুয়ারি থেকে পোশাকের মূল্য ও চাহিদা কমতে থাকে। এ ধারা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বিশেষ করে আগস্টে ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাকের মূল্য কমেছে ৫ শতাংশ। সেখানে সেপ্টেম্বরে আরও কমে ১৩ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। একইভাবে পোশাকের মূল্য কমেছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও। সেপ্টেম্বরে পোশাকের বিক্রয় মূল্য যুক্তরাষ্ট্রে হ্রাস পেয়েছে ৯ শতাংশ। দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে অক্টোবরে এটি আরও কমে ১৩ শতাংশ হয়েছে। পোশাকের মূল্য পতনের তথ্য তুলে ধরে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, করোনা পরিস্থিতির আগ থেকেই পোশাকের মূল্য পতন হচ্ছে। যা করোনার মধ্যে তীব্র আকার ধারণ করেছে। ২০১৪-১৯ এ ৫ বছরে দেশের পোশাক রফতানির মূল্য বছরে গড়ে হারিয়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। করোনাকালে সেপ্টেম্বরে বিশ্বব্যাপী পোশাকের মূল্য হারিয়েছে ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে পতন হয়েছে ৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। সামগ্রিকভাবে এ পতন ধারা অব্যাহত রেখে অক্টোবরে বিশ্বব্যাপী দেশের পোশাকের মূল্য পতন ঘটে ৪ দশমিক ১৫ শতাংশ। আর নভেম্বরের প্রথম ২০ দিনে মূল্য পতন হয়েছে ৪ দশমিক ৯২ শতাংশ।