Home বাংলা নিউজ এখন টিকে থাকাই দায়, বলছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা

এখন টিকে থাকাই দায়, বলছেন পোশাক রপ্তানিকারকরা

ঢাকা ইপিজেডের ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মনিরুল আলম শুভ বললেন, ‘হাবুডুবু খাচ্ছি’। চট্টগ্রামের এরিয়ন ড্রেস কারখানার মালিক মোহাম্মদ আতিক জানালেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি টেনেটুনে চালালেও মার্চে কোনো রপ্তানি আদেশ নেই তার হাতে। ঢাকার তেজগাঁওয়ের পস গার্মেন্টসের পরিচালক ওয়াসিম জাকারিয়ার ভাষায়, রপ্তানিতে এমন খরা আগে কখনও দেখেননি তিনি।

পোশাক শিল্পের এই তিন উদ্যোক্তার কথায় ফুটে উঠল দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতে করোনাভাইরাস মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব কতটা গুরুতর হয়ে এসেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীর এই খাতে নতুন করে অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা উঠেছে। বাংলাদেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক থেকে, ফলে এই শিল্প দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত। মহামারী শুরুর পর গত মার্চে ডিজাইনটেক্স নামের একটি পোশাক কারখানায় নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হয়েছিল। গত বছরের মার্চে বাংলাদেশ ও এশিয়া অঞ্চলে যখন কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হয়, তার পরের মাসেই দেশের পোশাক খাত মুখ থুবড়ে পড়ে। গড় রপ্তানি দুই-তৃতীয়াংশ কমে এক বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে যায়। বেতন বকেয়া, আকস্মিক ছাঁটাই ও কর্মহীনতার মুখে পড়ে ঢাকা, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জের শ্রমঘন এলাকায় শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। এই পরিস্থিতিতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের বেতন চালিয়েছিল পোশাক শিল্প মালিকরা। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রপ্তানি বাড়ায় তারা আশাবাদী হলেও নতুন বছরের শুরুতে নেমে এসেছে হতাশা। ১৯৮৮ সাল থেকে ঢাকার তেজগাঁও শিল্প এলাকায় পস গার্মেন্টস চালিয়ে আসা ওয়াসিম জাকারিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন পিক সিজন থাকার কথা, অর্থাৎ ১০ থেকে ১১ ঘণ্টা ব্যস্ত থাকার কথা। “সাধারণত ৯০ দিন আগে থেকেই সব অর্ডার বুক করা হয়। অথচ এখন আট ঘণ্টা করে কাজ করলেও ফেব্রুয়ারির মধ্যে সব অর্ডার শেষ হয়ে যাবে। মার্চের পরে কোনো অর্ডারই নেই। মার্চের কাজ কবে আসবে সেটা বলা যাচ্ছে না।” ১২০০ শ্রমিকের এই কারখানায় উৎপাদিত লেডিস গার্মেন্টস ইউরোপের ১২টি দেশ, মেক্সিকো, তুরস্ক, সিঙ্গাপুরসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। ওয়াসিম বলেন, সাধারণত লাভ করতে হলে দৈনিক ১০ ঘণ্টা করে চালাতে হয়। এখন ৮ ঘণ্টা করে চলছে, তাতে খরচ কিছুটা পোষাচ্ছে। কারখানা মালিকরা বলছেন, অর্ডার কমে যাওয়ায় শ্রমিকের সংখ্যাও কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছেন তারা।চট্টগ্রামের চকবাজারের এরিয়ন ড্রেস কারখানার মালিক মোহাম্মদ আতিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি মূলত ইউরোপে রপ্তানি করে থাকি। উভেন ও নিট সেক্টর মিলিয়ে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে সক্ষমতার ৬৫ শতাংশে কাজ চলছে। মার্চ মাসের জন্য আগাম কোনো অর্ডার নেই।” ২০০৩ সাল থেকে সাড়ে তিনশ শ্রমিক ও কর্মকর্তা নিয়ে ছোট পরিসরে পোশাক রপ্তানি করে আসছে এরিয়ন ড্রেস। এমন সঙ্কট আগে দেখেননি বলে জানান এর মালিক আতিক। ঢাকা ইপিজেডের সফটটেক্স সোয়েটারের মাসে ১০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি সক্ষমতা রয়েছে। এই কারখানারও মার্চের কোনো রপ্তানি আদেশ নেই। সফটটেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রেজওয়ান সেলিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, জানুয়ারিতে ৪৪ শতাংশ সক্ষমতায় চলছিল। ফেব্রুয়ারিতে ২০ শতাংশে নেমে যাবে। “সাধারণত অর্ডারগুলো তিন মাস আগেই আসে। মার্চ মাসের জন্য কোনো অর্ডারই নেই। শ্রমিক সংখ্যা ১৩০০ থেকে সাড়ে আটশতে নামিয়ে আনা হয়েছে।” তিনি বলেন, “ইউরোপে এখন সব দেশেই লকডাউন। দোকানপাট সব বন্ধ। অর্ডার কমে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। খুবই খারাপ অবস্থা, এই পরিস্থিতিতে সামনে কীভাবে সার্ভাইব করব, সেটা এখনই বলা কঠিন।” আরেক কারখানা ফ্যাশন ডটকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান মনিরুল আলম শুভ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত মাসে উভেনে তার কারখানার রপ্তানি আদেশ ১৮ শতাংশ কমেছে। বর্তমানে তার উভেন শাখায় ৪৫ দিনের ও নিট শাখায় ৩৫ দিনের কাজ আছে। সাধারণত ১০ ঘণ্টা করে কাজ চললেও সেটা এখন আট ঘণ্টায় নামিয়ে এনেছেন। নতুন অর্ডার নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, “একদিকে সুতার দাম বেড়েছে, অন্যদিকে নতুন অর্ডারগুলোতে পণ্যের দাম কমেছে। এখন সামান্য লোকসান নিশ্চিত জেনেও শুধু কারখানা সচল রাখার স্বার্থে অর্ডারগুলো নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি।” তিনি বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে তুলার দাম বেড়েছে। তাই প্রতি কেজি সুতার দাম ২ দশমিক ৬ ডলার থেকে বেড়ে ৩ দশমিক ৬ কেজি হয়েছে। বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা, সেখানে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভিশুভ বলেন, নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ হচ্ছে গার্মেন্টের বিশেষ পিক সিজন। এই সময় ১০-১১ ঘণ্টা কাজ করেও শেষ করা যায় না। নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকত না। “মার্চ-এপ্রিলের দিকে ইউরোপে সামার শুরু হয়। তাই এই সময়ে টি-শার্টগুলোর অর্ডার পড়ার কথা। কিন্তু সেটা এখন নেই।” পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতারা দামও কমিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান তিনি। “বায়াররা যে দাম অফার করছে, তাতে কাপড়ের দাম পোশাকের দামকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বায়াররা সুবিধা নিচ্ছে, যেহেতু কারখানায় অর্ডার নেই।” পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠনের নেতারা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিপর্যস্ত হওয়ায় দেশের পোশাক খাত বড় ধাক্কা খাবে। বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মনে করেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা আগের চেয়েও বেশি উদ্বেগের। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ইউকে, জার্মান, ফ্রান্সের অবস্থা খারাপ। আমেরিকার অবস্থাও ভাল না। আমাদের যেহেতু ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের জিনিসপত্র, বড়দিনের বিক্রিও খারাপ হয়েছে। বিক্রি বন্ধ করে দিতে হয়েছে ওদের। “প্রথম ঢেউয়ে কিন্তু এতটা ছিল না, এখন অবস্থা খুবই খারাপ। সবাই টার্গেট করেছিল, ক্রিসমাসে ক্ষতিটা পুষিয়ে উঠবে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। বড়দিনকে সামনে রেখেই ইউরোপ-আমেরিকায় সারা বছরের ৫০ শতাংশের মতো বিক্রি হয়। সেটা যখন ড্রপ করে তখন তাদের সবাই ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেকে অর্ডার বুকিং দিয়েও পরে সেগুলো ইস্যু করেনি।” ইভেন্স গ্রুপের চেয়ারম্যান পারভেজ বলেন, “অর্ডার পাওয়া এখন ভাগ্যের খেলায় রূপ নিয়েছে। “তারা (ক্রেতারা) দামটাও অনেক কমিয়ে দিয়েছে। যে কারণে ওই দামে অনেকেই অর্ডার নিতে পারছে না। যাদের বেশি ক্রাইসিস, তারা না পারতে কম দামের অর্ডারগুলো নিচ্ছে।” উভেন পোশাক রপ্তানি কমেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু মানুষের সামাজিক জীবনযাপন নেই, অফিসে যাচ্ছে না, পার্টিতে যাচ্ছে না। ফলে ফরমাল শার্ট, ট্রাউজারে অ্যাফেক্টটা বেশি পড়েছে। এজন্য উভেনে রপ্তানিটা কমছে। “নিটে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অর্ডার আসছে। আর উভেনে ৪০ শতাংশ রপ্তানি কম হয়েছে। উভেন সেক্টরে সর্বোচ্চ ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশের মতো অর্ডার আসছে।” রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ১ হাজার ৫৫৪ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৩ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যের চেয়ে কম ৪ দশমিক ১২ শতাংশ। এই ছয় মাসে নিট পোশাক রপ্তানি থেকে আয় ৩ শতাংশ বাড়লেও উভেন পোশাক রপ্তানি আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ১০ দশমিক ২২ শতাংশ কমেছে। রপ্তানিতে ধস নামায় শ্রমিকদের উপরও চাপ বাড়ছে বলে স্বীকার করেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি পারভেজ। তিনি বলেন, “সাধারণত তাদের কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা হলেও আমরা ৬ ঘণ্টা থেকে ৭ ঘণ্টা কাজ করাচ্ছি। অর্ডার না থাকলে ওভারটাইম করাব কী করে? আট ঘণ্টা চালানোর মতো অর্ডারই পাওয়া যাচ্ছে না। “যেসব ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে গেছে, সেখানে মানুষ চাকরি হারিয়েছে। তারা অর্ডার না পাওয়ায়ই এটা হয়েছে। তবে ছাঁটাই করে দেওয়া হয়েছে, এমনটি হয়নি।” অগাস্টের আগে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার আশা দেখছেন না এই পোশাক রপ্তানিকারক। তাই সরকারের প্রণোদনা ঋণ পরিশোধের সময় দুই বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর করার দাবি জানিয়েছেন তিনি। “আগামীতে আগের মতো অর্ডার আসলেও সমস্যাটা হবে প্রণোদনার ঋণ পরিশোধ নিয়ে। আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যদি ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে অধিকাংশ কারখানা অচল হয়ে পড়বে। কারণ ফুলস্কেলে গেলে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল লাগবে, সেটা থেকে যদি তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হয়, তাহলে সেটা তার জন্য যথেষ্ট হবে না।” শ্রমিকের বেতন বাবদ সরকার পোশাক খাতকে যে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ দিয়েছিল; আট মাসের গ্রেড পিরিয়ড শেষে জানুয়ারি থেকেই তা পরিশোধ শুরু হওয়ার কথা। সেই টাকা পরিশোধের সময় আরও ছয় মাস বাড়িয়ে দিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করছেন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক। তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে খোলা চিঠি দিয়েছিলাম। অর্থমন্ত্রী দীর্ঘদিন দেশের বাইরে ছিলেন; সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরেছেন। এখন আমাদের কাজ হবে অতি দ্রুত তার সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতির নাজুকতা তুলে ধরা।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here