২০১২ সালের কথা৷ আমি তখন ঢাকায় থাকি৷ আমাদের বাড়ির ঘর মোছা আর কাপড় ধোয়ার কাজ করতেন সালমা৷ বয়স ২৫ থেকে ৩০- এর মধ্যে৷ বাড়ির কাছে টিনের ঘরে থাকতেন৷ স্বামী রিকশা চালান আর সালমা বাড়ি বাড়ি কাজ করেন৷ মাসে চার হাজার টাকা দেয়া হয়৷ প্রায়ই ওর কাছে শুনি স্বামী মারধোর করে৷ বলে এই স্বামীর ঘর করবে না৷ ভালো চাকরি পেলে ছেড়ে দেবে৷ ভালো চাকরি কোনটা জিজ্ঞেস করলে বলে গার্মেন্টেসে চাকরি করবে৷ এই সালমা একদিন সত্যি সত্যি তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি পেয়ে গেল৷ কাজ ছেড়ে যেদিন পাওনা টাকা নিতে এলো, ওর মুখের দিকে চেয়ে দেখেছিলাম আত্মতৃপ্তির হাসি৷ বলেছিল, ‘‘আপা, এখন থেকে আর বলতে হবে না অন্যের বাসায় কাজ করি৷ এখন দেশে গেলে বলবো গার্মেন্টসে চাকরি করি৷ লোকজন সম্মান দিয়ে কথা বলবে৷’’কেমন আছেন পোশাক শ্রমিকরাচাকরির খোঁজেকে এ ডাব্লিউ গার্মেন্টসে প্রধান ফটকের বাইরে ফারজানা আক্তার দাঁড়িয়ে কথা বলছেন নিরাপত্তারক্ষীর সঙ্গে৷ করোনায় স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের খরচ সামলাতে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে৷ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে এসেছেন তিনি চাকরির খোঁজে৷ কারখানার নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে পরে আসতে বলে বিদায় দিলেন৷ এর পরের বছরই দেশ ছেড়েছি৷ জানি না সালমা এখন কেমন আছে৷ করোনায় সংবাদপত্রে যতবার পোশাকশিল্প কারখানার খারাপ খবরগুলো চোখে পড়ছিল, ততবার মনের মধ্যে ভেসে উঠছিল সালমার সেই আত্মতৃপ্তির হাসিভরা মুখটা৷ এমন কত সালমা ঢাকায় কাজ করার স্বপ্ন নিয়ে গ্রাম বা মফস্বল শহর থেকে আসেন৷ এখন ঢাকায়, এমনকি দেশের বাড়িতে গেলেও শুনতে পাওয়া যায়- ‘‘আজকাল কাজের লোকের অভাব, কারণ, সবাই গার্মেন্টসে চাকরি করে৷’’ এটা একটা দেশের উন্নয়নের প্রতিচ্ছবি৷ কিন্তু সেই উন্নয়ন হঠাৎ বাধাগ্রস্ত হলো করোনার কারণে৷ এই মহামারি ধনীদের সম্পদ আরো বাড়ালো আর গরিবদের আরো নিঃস্ব করে দিলো৷ বাংলাদেশে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর গত বছর তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক৷ নতুন এক গবেষণায় দেখা গেছে, চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে৷ এমনকি অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে৷ গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ’র (এমআইবি) সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশের বেশি কারখানায় শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনেক বেশি অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে৷ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫ লাখ ৬২ হাজার ৩৮৩ কর্মীর মধ্যে প্রায় তিন লাখ ৫৭ হাজার ৪৫০ জনের মতো চাকরি হারিয়েছেন, যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ৷ সিপিডি জানিয়েছে, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে নিয়ম মানা হয়নি৷ মাত্র তিন দশমিক ছয় শতাংশ কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনে বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে৷ সিপিডি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আগে ছাঁটাইকৃত কর্মী৷ নতুন করে নিয়োগ দেওয়ার সময় তাদের আরো কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে৷ শ্রমিকরা চাকরি পেলেও আগের চাকরি চলে যাওয়ার কারণে তারা উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত হয়েছে৷ সমীক্ষার এই চিত্র থেকেই স্পষ্ট, তৈরি পোশাক কারখানার শ্রমিকদের জন্য সামনে আরো ভয়াবহ সময় আসছে৷ করোনাকাল যদি আরো দীর্ঘ হয়, তাহলে হয়ত আবার তাদের পুরোনো জীবনে ফিরে যেতে হবে৷ কেউ হয়ত নিজ এলাকায় ফিরে যাবেন, অনেকে হয়ত অন্য পেশা বেছে নেবেন৷ কিন্তু সালমাদের মতো যারা উন্নত জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের স্বপ্ন কি অধরাই থাকবে?