বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই সাড়ে চার হাজার টাকা বেতনে পোশাক খাতের প্রয়োজনীয় একসেসরিজ বা সরঞ্জাম উৎপাদক বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি নেন। কোয়ালিটি অফিসার হিসেবে দুই বছর চাকরি করে সরঞ্জাম উৎপাদনকারী এক দেশীয় প্রতিষ্ঠানে প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট পদে যোগ দেন। বেতন ১৫ হাজার টাকা। চার বছর পর সেই চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ব্রিটিশ এক রাসায়নিক (কেমিক্যাল) কোম্পানির বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান প্রধান হিসেবে কাজ শুরু করেন।
চাকরির এই ইতিবৃত্ত আল শাহরিয়ার আহমেদের। ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরির পাশাপাশি ২০১২ সালে কোনো পুঁজি ছাড়াই ইন্ডেনটিং ফার্ম করলেন। ছয় বছরের চাকরির অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরঞ্জাম খাতের বিভিন্ন কোম্পানির জন্য যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও রাসায়নিক আমদানি করতেন শাহরিয়ার। তারপর অংশীদারত্বে দুটি কারখানা করলেন। কিছুদিন ব্যবসা করে শেয়ার ছেড়ে দিয়ে নিজেই করলেন রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য উৎপাদনের কারখানা।
চার বছরের ব্যবধানে শাহরিয়ারের আদজি ট্রিমস লিমিটেড সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য উপখাতের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হয়ে উঠেছে। বর্তমানে তুরাগ ও ধামরাই বিসিক শিল্পনগরীতে আদজি ট্রিমসের দুটি কারখানায় কাজ করেন ৮৯৩ কর্মী। জারা, ম্যাঙ্গো, পুল অ্যান্ড বিয়ার, অ্যালকোড ইংলিশসহ বিদেশি ৩১ প্রতিষ্ঠানের হয়ে সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানটি। তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি রপ্তানি হচ্ছে ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, মরক্কো, পর্তুগাল, ভিয়েতনাম ও স্পেনে। তাতে প্রতি মাসে প্রায় ১০ লাখ মার্কিন ডলার বা সাড়ে আট কোটি টাকার সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য প্রচ্ছন্ন ও সরাসরি রপ্তানি করছে শাহরিয়ারের আদজি ট্রিমস।
রাজধানীর উত্তরায় নিজের কার্যালয়ে গত মঙ্গলবার নিজের উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প শোনালেন ৩৪ বছরের যুবক আল শাহরিয়ার আহমেদ। বললেন, ‘সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য উপখাতে আমরা ক্রেতাদের ওয়ান-স্টপ সার্ভিস দিতে চাই। মানে হচ্ছে, তৈরি পোশাকশিল্পের সব ধরনের সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্যই আমাদের কারখানায় হবে। বর্তমানে আমরা জিপার, বোতাম, কার্টন ও সুইং থ্রেড ছাড়া সব পণ্য করছি। আগামী বছর জিপার ও বোতাম উৎপাদনে যাব আমরা।’
ছোটবেলাতেই উদ্যোক্তার স্বপ্ন
আল শাহরিয়ার আহমেদের শৈশব কেটেছে পটুয়াখালী সদরে। ছোটবেলার একটি ঘটনা ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হওয়ার পেছনে বেশ প্রভাব ফেলে তাঁর ওপর। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ছেলে বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তখন শাহরিয়ার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়েন। ঘটনাটা তাঁর মুখেই শুনুন, ‘আমার শিক্ষকের ছেলেকে জিজ্ঞেস করলাম, আঙ্কেল, আপনি বেতন কত পান? বললেন, মাসে ৩৫ হাজার টাকা। আমি বড়সড় ধাক্কা খেলাম। কারণ, তখন ৩৫ হাজার অনেক টাকা। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি কোম্পানির সবকিছু দেখেন? উত্তর দিলেন, না। তাঁর ওপরে আরও অনেক কর্মকর্তা আছেন। শীর্ষ কর্মকর্তার বেতন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা। আবার প্রশ্ন করলাম, বেতন কে দেয়? উত্তর দিলেন, কোম্পানির মালিক। আমার ছোট্ট মাথায় এল, কোম্পানির মালিক যিনি এত টাকা বেতন দেন, তাঁর বেতন না জানি কত!’
শাহরিয়ার বললেন, ‘সেদিনই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি হলে কোম্পানির মালিকই হব। আমার প্রতিষ্ঠানে অনেক মানুষ কাজ করবেন। তা ছাড়া আমার পরিবারের সবাই সরকারি চাকরি করেন। তাঁদের সাদাকালো জীবন আমাকে আকর্ষণ করত না।’
চাকরি ছেড়ে শাহরিয়ারের বাবা ব্যবসা শুরু করেন। সেই সুবাদে ১৯৯৮ সালে সাভারের নবীনগরে চলে আসে তাঁদের পরিবার। শাহরিয়ার ভর্তি হলেন বেপজা পাবলিক স্কুলে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরপরই বন্ধুদের সঙ্গে একটি ঘটনা নিয়ে মারামারি হয় শাহরিয়ারের। বাবা রাগ করে তাঁকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেন। অভিমান করে শাহরিয়ারও নারায়ণগঞ্জ চলে গেলেন। সেখানে মাসখানেক বন্ধুদের সঙ্গে থাকার পর মামার ব্যবসা কয়েক দিন দেখাশোনা করেন। এদিকে উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বের হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষমাণ তালিকায়ও ছিলেন।
অবশ্য তার আগেই নবীনগরে পরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে একসেসরিজ বা সরঞ্জাম উৎপাদক বহুজাতিক কোম্পানি পেক্সার বাংলাদেশ লিমিটেডে চাকরির সুযোগ পান শাহরিয়ার। চাকরি শুরু করলেন। পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। তবে চাকরির কারণে লেখাপড়ায় সুবিধা করা যাচ্ছিল না। পরে ইভনিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যান শাহরিয়ার।
সকাল ছয়টায় বাসা থেকে রওনা দিতাম। দিনে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কাজের চাপে টানা দু-তিন রাত কারখানার ভেতরে সোফায় রাত কাটিয়ে দিতে হতো।
অবশেষে উদ্যোক্তা হওয়া
শাহরিয়ারের চাকরির ইতিবৃত্ত আগেই শুনেছি আমরা। এলিট প্রিন্টিং ইউকে লিমিটেড নামের ব্রিটিশ রাসায়নিক কোম্পানিতে মাসে তিন হাজার পাউন্ডের চাকরির পাশাপাশি নিজের ইন্ডেনটিং ফার্ম চালাচ্ছিলেন। হঠাৎ একদিন কসমো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ারকে তাঁর অফিসে দেখা করতে বলেন। দেখা করতে গেলে ওই ব্যবসায়ী শাহরিয়ারকে যৌথভাবে স্টিকার ও গামটেপ উৎপাদনের প্রস্তাব দেন।
শাহরিয়ার বললেন, কারখানা করার মতো অনেক টাকা নেই। পরে অবশ্য আট লাখ টাকা দিয়ে কোম্পানির ১৫ শতাংশ শেয়ার পান। ঈশ্বরদী ইপিজেডে ফুজিয়ান এক্সপোর্ট ইন্ডাস্ট্রির নির্মাণকাজ শুরু হয়। নানা কারণে কারখানার নির্মাণকাজ বিলম্ব হচ্ছিল। তখন কসমো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের উদ্যোগে গাজীপুরে ভিক্টোরিয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি নামের আরেকটি সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য উৎপাদনের কারখানা করলেন। সেখানে শাহরিয়ারের শেয়ার ২০ শতাংশ।
আল শাহরিয়ার আহমেদ বললেন, ‘গাজীপুরে কারখানাটিকে দাঁড় করাতে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। সকাল ছয়টায় বাসা থেকে রওনা দিতাম। দিনে কমপক্ষে ১৮ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। কাজের চাপে টানা দু-তিন রাত কারখানার ভেতরে সোফায় রাত কাটিয়ে দিতে হতো।’
বছর চারেক ব্যবসা চালানো পর একদিন শেয়ার ফেরত দিয়ে টাকা নিয়ে নিলেন। বন্ধু শিকদার সাফিউজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন আদজি ট্রিমস। দুটি ব্যাংক ও স্পেনের এক ক্রেতার সহযোগিতায় তুরাগে ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রথম কারখানা চালু হলো।
কারখানার শুরুর দিকের কথা বললেন আল শাহরিয়ার আহমেদ, ‘প্রথম দিকে কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। আর্থিক সংকট ছিল। অনেক দিন নিজের ক্রেডিট কার্ডের টাকা দিয়ে কারখানার ডিজেল কিনতে হয়েছে। তবে পথঘাট চেনা থাকায় দ্রুত আমরা উন্নতি করতে পেরেছি।’
আদজি ট্রিমস বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের ওভেন লেবেল ও ট্যাগ, টুইল ট্যাপ, কাগজের মোড়কপণ্য, পলিব্যাগ ইত্যাদি তৈরি করে। পরিবেশ সুরক্ষায় পচনশীল পলিব্যাগ প্রস্তুত করছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশে হাতে গোনা যে কয়টি রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি আইডেনটিফিকেশন বা আরএফআইডি লেবেল ও ট্যাগ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তার মধ্যে আদজি ট্রিমস অন্যতম।
আল শাহরিয়ার আহমেদ বর্তমানে সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্যের পাশাপাশি কৃষিপণ্যে বিনিয়োগ করছেন। করোনার কারণে কিছুটা পিছিয়ে গেলেও শিগগিরই ধামরাইয়ে কৃষি খামার ও বীজ উৎপাদনে যাচ্ছে তাঁর দুই প্রতিষ্ঠান। বললেন, ‘কৃষিতে ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি আমরা কাজে লাগাতে চাই।’
তৈরি পোশাক খাতে সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্যে ৮৫-৯০ শতাংশ দেশীয় প্রতিষ্ঠান জোগান দেয়। বাকিটা বিদেশ থেকে আমদানি হয়। সে কারণে সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্যের উপখাতে বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে। এমন মন্তব্য করে আল শাহরিয়ার আহমেদ বলেন, পোশাক ছাড়াও খাদ্য, ওষুধসহ সব ধরনের পণ্যেই মোড়কপণ্যেও চাহিদা রয়েছে। কীভাবে সরঞ্জাম ও মোড়কপণ্য তৈরি হয়, সেই টেকনিক্যাল বিষয়গুলো জেনে এই ব্যবসায় আসতে হবে।