বিপদ যেন কিছু ছাড়ছেই না। বৈশ্বিক মহামারী করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত গোটা শিল্প অর্থনীতি। আশা ছিল, গত বছরের অক্টোবর নভেম্বরে করোনার প্রভাব কমে আসবে। শুরু হবে স্বাভাবিক জীবন প্রবাহ। ঘুরে দাঁড়াবে বিশ্বের শিল্প অর্থনীতি। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় নতুন করে লকডাউনের মুখে পড়েছে শিল্প অর্থনীতি। যা বছর পেরিয়ে গেলেও তেমন কোনো উন্নতি হয়নি। ফলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্প সংকট মুক্ত হতে পারেনি। সংশ্লিষ্টদের আশা ছিল, ক্রেতা দেশগুলোয় মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে লকডাউন শিথিল হয়ে যাবে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি; বরং গত ৮ মার্চ থেকে লকডাউনের সময়সীমা বাড়ানো এবং লোক সমাগম বন্ধে কঠোর আইন করায় আবারো অনিশ্চয়তায় পড়তে হয়েছে পোশাক খাতকে। উল্লেখ্য, দেশের তৈরি পোশাকের ৬০ ভাগেরও বেশি ক্রেতা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) ২৭টি দেশ। আর এসব দেশেই করোনার প্রকোপের ঢেউ বারংবার আঘাত হানছে, ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতির বড় চালিকা শক্তি পোশাক খাতের সংকট দিনদিন বেড়েই চলছে।
গত ৮ মার্চ পর্যন্ত জার্মানি ও নেদারল্যান্ডসসহ কয়েকটি দেশের লকডাউন পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এসব দেশ চলতি মাসের পুরোটা সময় এবং ইস্টার হলিডের কারণে আগামী ৮ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউনের সময় বাড়ানো হতে পারে। এ অবস্থায় পোশাকের নতুন অর্ডার না আসায় অনেকটাই হতাশ হয়ে পড়েছেন পোশাক শিল্পের মালিকরা। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সহ-সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, করোনাভাইরাসের কষাঘাতে বিপর্যন্ত গোটা দুনিয়ার শিল্প খাত। এর থেকে রেহাই পায়নি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের বড় খাত তৈরি পোশাক শিল্পও।
গত বছর জুড়েই ছিল পোশাক রপ্তানিতে ভাটা। অর্ডার না থাকায় বন্ধ হয়েছে অনেক পোশাক কারখানা। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার পোশাক কর্মী। নতুন বছরে এসে আশা করেছিলাম, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হবে, ঘুরে দাঁড়াবে পোশাক খাত। কিন্তু করোনার প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় সংকট দীর্ঘায়িতই হচ্ছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, করোনার বিরূপ প্রভাবে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হলেও আমাদের অর্থনীতি তুলনামূলক ভালোই আছে। পোশাকখাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। কর্মহীনরা আবার কাজে ফিরে আসবে। এ জন্য ধৈর্যসহকারে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আর সরকারও পোশাক খাতকে রক্ষায় সার্বিক সহযোগিতা করছে, আমরা আশাবাদী, পোশাক খাতের সুদিন ফিরবে। রাত হলে সূর্য উদিত হবে, অন্ধকার কেটে যাবে, মানুষ আলোর দেখা পাবে, এটাই চিরন্তন সত্য। করোনা মহামারী তো মনুষ্যসৃষ্ট কোনো সংকট নয়, এ সংকট উত্তরণে গোটা বিশ্বই কাজ করছে। শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন কার্যক্রম। এখনো দ্বিতীয় ডোজ সবখানে শুরু হয়নি, আবার অনেকেই টিকাও নিচ্ছেন না। ফলে কোনো কোনো দেশে সংকট থাকলেও আমরা আশাবাদী, টিকার কর্মযজ্ঞ দিয়েই এই মহামারীকে রোধ করা সম্ভব। তবে করোনার ছোবলে দেশের পোশাক খাত যে ক্ষতির মুখে পড়েছে, এটা স্বীকার করতেই হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সব মিলিয়ে রপ্তানি কমেছে ৫৭৩ কোটি ডলার বা প্রায় ৪৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধু পোশাক রপ্তানি কমেছে ৫৬০ কোটি ১৭ লাখ ডলার বা ৪৭ হাজার ৬১৪ কোটি টাকা। ইপিবি সূত্র বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) এক হাজার ৫৫৪ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৯৯ শতাংশ কম। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ১২ শতাংশ কম। সাম্প্রতিক সময়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, গত ৭ মাসে তৈরি পোশাক শিল্পের কর্মরত শ্রমিকদের প্রায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজেম বলেন, গত বছরের মার্চের করোনা সংক্রমণ শুরু হলে শ্রমিকদের বাস্তব অবস্থাসহ সার্বিক অবস্থা জানতে প্রায় সাত শতাধিক কারখানার ওপর সাত মাস ধরে জরিপ করেন। জরিপে দেখা গেছে, এই সাত মাসে ৭ শতাংশ বা ২৩২টি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়েছে। এছাড়া লে-অফ ঘোষিত হয়েছে ২ দশমিক ২ কারখানায়। আর ৩০ শতাংশ পোশাক কারখানা শ্রমিকদের বেতন ভাতা দিতে পারেনি। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে এবং রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকার ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দেন।
সেই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ঋণ নিয়ে গত বছরের এপ্রিল-জুনে ৩৫ লাখ পোশাক কর্মীকে ব্যাংক বা মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেতন দেওয়া হয়। শর্ত ছিল, এই ঋণ ১৮ মাসে পরিশোধ করতে হবে। দুর্ভাগ্য, পোশাক খাত আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে নতুন করে পোশাক শিল্পের টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ফলে পোশাক শিল্পের মালিকরা প্রণোদনার খাতের এই বিশেষ ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ১৮ মাস থেকে বাড়িয়ে ৫ বছর এবং গ্রেস পিরিয়ড ৬ মাস থেকে বাড়িয়ে ১২ মাস করার প্রস্তাব দিয়েছে। অবশ্য পোশাক শিল্প মালিকদের এ দাবি যৌক্তিক, কারণ এখনো তো এ খাত ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না। সঙ্গত কারণে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। আর এই পোশাক শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত গ্রামীণ অর্থনীতি। মূলত এই শিল্পের বদৌলতে গ্রামীণ জীবনে কর্মহীনদের ন্যূনতম কাজের নিশ্চয়তা হয়েছে। এই শিল্পের কারণে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ লক্ষ বেকারের, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী।
এসব নারীদের বসবাস গ্রামে। যারা এক সময় গ্রামে কিংবা শহরে পেটে ভাতে নানা কাজে জড়িত ছিল। অন্তত এই শিল্পের বদৌলতে তাদের সে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্রামের বেকার মেয়েরা লেখাপড়া শেষ করে কিংবা অর্ধশিক্ষিত অবস্থায় পরিচিত কারও হাত ধরে পোশাক কারখানায় কাজ খুঁজে নেয়। ফলে এখন গ্রামীণ জীবনে আর বেকার কোনো নারীকে সহসাই খুঁজে পাওয়া যায় না। কম-বেশি সবাই কাজ নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন। এমন এক সময় ছিল, যখন কাজের জন্য মেয়ে কিংবা মহিলার অভাব হতো না। এখন কিন্তু সে চিত্র পাল্টে গেছে, এখন চাইলেই বাসা-বাড়িতে কাজের মেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ সবাই এখন শহরমুখী নানা কাজের সঙ্গে জড়িত। আর বাসা-বাড়িতে এখন কেউ কাজ করলেও আগের সেই পেটে ভাতের শর্তে পাওয়া যায় না। উপযুক্ত মূল্য দিয়েই কাজ করাতে হয়। অর্থাৎ পোশাক শিল্প নারীদের কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তাটুকু দিয়েছে। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি এসেছে। কোনো কারণে এ খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর বিরূপ প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি সবচেয়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। সঙ্গত কারণে রপ্তানিমুখী এই পোশাক শিল্পকে প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা, সহায়তা দিয়ে টিকে রাখতে সরকারকে আন্তরিক হতে হবে।
বিজিএমইএর পরিচালক ও গোল্ডেন রেফিট গার্মেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা একটা অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। প্রতি মাসে রপ্তানির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকে, তা থেকে এখন ২০ শতাংশের নিচে রপ্তানি হচ্ছে। ক্রেতা দেশগুলোর করোনার কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বান্ধ। লকডাউনের সময়সীমাও বৃদ্ধি পাচ্ছে, আবার পোশাকের নতুন কোনো বাজারও সৃষ্টি হচ্ছে না। আর আমাদের পোশাক খাতের মোট বাজারের ৮৫ ভাগই ইউরোপ এবং আমেরিকার ওপরই নির্ভরশীল বলেও তিনি মন্তব্য করেন। হতাশা প্রকাশ করে দিগন্ত সোয়েটার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর যে ভালো হবে, সেটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ ইউরোপের বাজার এখনো বন্ধ রয়েছে। বায়াররাও শঙ্কিত। তবে ব্যবসায়ীদের আশা, করোনা ভ্যাকসিন গ্রহণ শুরু হয়েছে, হয়তো পরিস্থিতির উন্নতি হবে। আর পরিস্থিতির উন্নতি হলে আবার ঘুরে দাঁড়াবে পোশাক খাত। নিশ্চিত হবে স্বল্প বেতনভুক্ত শ্রমিকদের রুটি-রুজি। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পাবে, দেশের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিসি) গত ৩ মার্চের রপ্তানি আয়ের সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি পোশাক খাত। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বিশ্ববাজারে রপ্তানি কমেছে ৩ দশমিক ৯২ শতাংশ। অর্থাৎ চলতি ফেব্রুয়ারিতে রপ্তানি হয়েছে ৩১৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের, যা আগের বছরে ছিল ৩৩২ কোটি ২৪ লাখ ডলার। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় কমেছে ১৩ কোটি ৬ লাখ ডলার বা প্রায় ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা।
তবে আশার খবর হলো, বিরূপ পরিস্থিতির মাঝেও চলতি অর্থবছরের জুলাই ’২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ’২১ পর্যন্ত এই আট মাসে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করে মাইলফলক স্পর্শ করেছে তৈরি পোশাক খাত। পোশাক শিল্পের মালিকরা বলছেন, করোনার কারণে মূল্য হ্রাস হয়েছে। তা না হলে রপ্তানি আয়ের পরিমাণ আরও বেড়ে যেত। তবে, করোনার শুরুতে এ খাতে ব্যাপক বিপর্যয় ঘটলেও আশঙ্কার চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে।
দিগন্ত সোয়েটার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কামাল উদ্দীন এ প্রসঙ্গে বলেন, প্রথমে যতটা খারাপ হবে মনে করেছিলাম, ততটা কিন্তু খারাপ হয়নি। সরকার আমাদের প্রণোদনা দিয়ে সহায়তা করেছে, তা না হলে ব্যাপক ক্ষতি হয়ে যেত। বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশে করোনার তীব্রতা পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম, আর পশ্চিমা দেশগুলোতে করোনার ঢেউ বেড়েই চলছে। আগে জীবন, তারপর ব্যবসা। ফলে ইউরোপ আমেরিকার ব্যবসা-বাণিজ্য বলতে গেলে বন্ধ প্রায়। ফলে আশার মাঝেও শঙ্কার জায়গাটা হচ্ছে, করোনা মহামারীর স্থায়ীকাল কতদিন বিদ্যমান থাকে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। আবার স্বস্তির দিক হচ্ছে, গোটা বিশ্বজুড়েই করোনার ভ্যাকসিন নেওয়া শুরু হয়েছে। হয়তো দ্বিতীয় ডোজের পর এর প্রভাব কিছুটা হলেও কমে আসবে। তখন মানুষের স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ ফিরে আসবে। ব্যবসা-বাণিজ্য চালু হবে। মানুষ জীবিকার টানে সামনেই এগোবে। হয়তো এ মুহূর্তে এগুলো ভাবা স্বপ্নই মনে হবে। তবে এটা সত্য, কোনো সংকটই চিরস্থায়ী নয়। একদিন সংকট কেটে যাবে, আমাদের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত আবার ঘুরে দাঁড়াবে, এটাই প্রত্যাশিত আশঙ্কা।