বিনা শুল্কে কাগজ আমদানি হলে কঠিন সংকটে পড়বে দেশি শিল্প। দেশের ১০৬টি কাগজ মিল স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানিতেও সক্ষম।এরই মধ্যে ৪০টিরও বেশি দেশে বাংলাদেশের কাগজ রপ্তানি হচ্ছে। অথচ এক শ্রেণির সুযোগসন্ধানী অসাধু ব্যবসায়ী দেশি কাগজশিল্প ধ্বংস করতে পাঠ্যপুস্তক ছাপানোর নামে বিনা শুল্কে কাগজ আমদানি করতে চাইছেন। আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিনা শুল্কে কাগজ আমদানির অনুমতি পেতে এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী মহলের সঙ্গে তারা যোগাযোগ করছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ অনুমতি দেওয়া হলে দেশি কাগজশিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে।
রোববার (১৪ মার্চ) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) আয়োজিত প্রাক-বাজেট আলোচনায় দেশি কাগজশিল্পের সংগঠন বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) প্রতিনিধিরা দেশি কাগজশিল্পের সম্ভাবনা ও সক্ষমতা তুলে ধরে এ দাবি জানান।
এ সময় সংগঠনটির পক্ষ থেকে বিপিএমএর বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান মো. মুস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী কমিটির সদস্য ফিরোজ আহমেদ এবং বিপিএমএ সচিব নওশেরুল আলম উপস্থিত ছিলেন। প্রাক-বাজেট আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এরই মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্প ও এর সহযোগী অন্য শিল্পে বিনা শুল্কে বন্ড সুবিধার নামে কাঁচামাল হিসেবে কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারের দেওয়া বন্ড সুবিধা ব্যবহার করে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী কারখানায় ব্যবহারের কথা বলে কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য আমদানি করে খোলাবাজারে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এতে সরকার প্রতিবছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে। পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য বিনা শুল্কে কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও একইভাবে অনেক অসাধু ব্যবসায়ী খোলাবাজারে বিক্রি করে দিতে পারেন। এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি আরো বাড়বে। একই সঙ্গে দেশি কাগজশিল্প অসম প্রতিযোগিতায় পড়ে লোকসানে ধ্বংস হয়ে যাবে। দেশের অর্থ বিদেশে চলে যাবে। অর্থনীতিতে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ’
এমন পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য কাগজ আমদানির সুযোগ দেওয়ার পরিবর্তে দেশি কাগজশিল্প সুরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন বিপিএমএ নেতারা।
মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিগত দিনে পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহারের জন্য দেশি কাগজ মিলগুলো গুণগত মানসম্পন্ন কাগজ সরবরাহ করে এসেছে। কাগজশিল্প বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ শিল্প খাত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাগজশিল্প আমদানি বিকল্প, রপ্তানিমুখী ও পরিবেশবান্ধব শিল্প খাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। ’
সংগঠনের লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ আছে, বর্তমানে দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০৬টি পেপার মিল রয়েছে। এসব মিল বছরে প্রায় ১৬ লাখ টন কাগজ উৎপাদন করতে সক্ষম, যা স্থানীয় চাহিদার তুলনায় ২.৫০ গুণ বেশি। এ চাহিদা পূরণ করে কাগজ ও কাগজজাতীয় পণ্য ৪০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়। কাগজশিল্প প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবিকা এ খাতের ওপর নির্ভরশীল। দেশি কাগজশিল্প খাতে উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা। কাগজশিল্প ঘিরে মুদ্রণ, প্যাকেজিং, বাঁধাই, ডেকোরেশনসহ ৩০০টির বেশি সহায়ক শিল্প গড়ে উঠেছে। সরকারি কোষাগারে এই খাত প্রতিবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব সরবরাহ করে।
বন্ড সুবিধার অপব্যবহার: এরই মধ্যে তৈরি পোশাক খাত ও এর সহযোগী শিল্পের কারখানায় ব্যবহারের জন্য সরকার বন্ড সুবিধা নামে শুল্কমুক্ত কাঁচামাল আমদানির সুবিধা দিয়েছে। কাঁচামালের মধ্যে রয়েছে ডুপ্লেক্স বোর্ড, আর্ট কার্ড, আর্ট বোর্ডসহ বিভিন্ন কাগজজাতীয় পণ্য। শর্ত থাকে, বন্ড সুবিধায় আনা পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করা যাবে না। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী বন্ড সুবিধায় পণ্য এনে কারখানায় ব্যবহার না করে খোলাবাজারে বিক্রি করে বছরে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকি দিচ্ছেন।
এনবিআরের সবেক চেয়াম্যান আবদুল মজিদ বলেন, ‘তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বিনা শুল্কে আমদানীকৃত কাগজজাতীয় পণ্য খোলাবাজারে বিক্রি করে এরই মধ্যে হাজার কোটি টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। এর সঙ্গে বিনা শুল্কে পাঠ্যপুস্তকের জন্য ব্যবহৃত কাগজ আমদানির অনুমতি দেওয়া হলে আর্থিক ক্ষতি আরো বাড়বে। দেশি কাগজশিল্প লোকসানে শেষ হয়ে যাবে। ’
মানসম্পন্ন কাগজ সরবরাহ: প্রতিবছর দরপত্রের মাধ্যমে এনসিটিবি ৮০ হাজার টন কাগজ ও ৪০ কোটি মুদ্রিত বই কিনে থাকে। বিপিএমএ সদস্যরা গত ২০ বছর ধরে এনসিটিবির চাহিদা অনুযায়ী মানসম্পন্ন কাগজ সঠিক মূল্যে যথাসময়ে সরবরাহ করে আসছে।
কাঁচামাল আমদানিতে ছাড় দাবি: বিপিএমএ নেতারা ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে কাগজশিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কাঁচামালের রাসায়নিকের আমদানি পর্যায়ে শুল্কহার হ্রাসের দাবি জানিয়েছেন। আমদানি করা ফিনিশড পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপেরও দাবি করেছেন তারা।