সাত বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন। পুরনো দুই প্যানেলে সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের হয়েই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন প্রার্থীরা। তবে নির্বাচনে জিততে মরিয়া হয়ে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ভোটার বাড়াতে বাস্তবে ব্যবসায়িক কার্যক্রম কিংবা কারখানার অস্তিত্ব নেই এমন প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে চূড়ান্ত ভোটার তালিকায়। এজন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সিটি করপোরেশনের নথি এমনকি কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর পর্যন্ত জাল হওয়ার তথ্য মিলেছে বণিক বার্তার অনুসন্ধানে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ২০১৩ সালে সাধারণ সদস্যদের সরাসরি ভোটে বিজিএমইএর পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচিত হয়েছিল। নতুন নেতৃত্ব ঠিক হবে আগামী ৪ এপ্রিলের নির্বাচনে। বর্তমানে সংগঠনটির সাধারণ সদস্যের সংখ্যা ৪ হাজার ৩৬৮। চূড়ান্ত ভোটার তালিকায় ঢাকা অঞ্চলে ১ হাজার ৮৫৩ ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ৪৬১ জন ভোটার রয়েছেন। এবারের নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সমিতির ৩৫টি পরিচালক পদের জন্য দুই প্যানেলের ৩৫ জন করে মোট ৭০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিজিএমইএর প্রকাশ করা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা ধরে চট্টগ্রামে সরেজমিন কারখানাগুলোতে অনুসন্ধান করেছে বণিক বার্তা। এতে তালিকা আর বাস্তব চিত্রের মধ্যে অসংগতি পাওয়া গেছে। সাধারণ সদস্যদের যে তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে তাতে ঠিকানা অনুযায়ী চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্ধশতাধিক কারখানার কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে থাকায় অনেকেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে সরে এসেছেন প্রায় ১০ বছর আগে। ফলে নিজ উদ্যোগে এনবিআর কিংবা সিটি করপোরেশনে রাজস্ব প্রদান কিংবা তথ্য হালনাগাদ করেননি তারা। অথচ ভুয়া কাগজপত্র ও কর্মকর্তাদের স্বাক্ষর জাল করে এসব প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভোটার তালিকায়।
কারখানার অস্তিত্ব কিংবা কোনো ধরনের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত না হওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে বেউ মন্ডি অ্যাপারেলস লি, বেউ মন্ডি গার্মেন্টস লি, মন্ডিটেক্স ফ্যাশন লিমিটেড, ফায়ারমন্ডি মনিটিং লিমিটেড, গাউস অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, গাউস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বাবুই নিট ফ্যাশন লিমিটেড, এবলি গার্মেন্টস লিমিটিড, পম্প অ্যান্ড ভেলি লিমিটেড, এমটিএস গার্মেন্টস লিমিটেড, শাহ-আজম টেক্সটাইল, লারসন ফ্যাশন লিমিটেড, ডিজাইন মেকার্স লিমিটেড, ড্রেস ডিজাইনার্স লিমিটেড, আরএএনএল ডিজাইনার্স লিমিটেড, টেকনো ড্রেস লিমিটেড, স্টেজ টু লিমিটেড, সেন্ট গার্মেন্টস লিমিটেড, দ্য লাকি অ্যাপারেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ইয়ান অ্যাপারেলস, লেগুন ক্লদিং লিমিটেড, লাইসিউম ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, মাইলস ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, লিডিং ফ্যাশন লিমিটেড, লিজেন্ড টেক্সটাইল লিমিটেড, এলএম মেশিনারা এশিয়া লিমিটেড, মুন ফ্যাশন লিমিটেড, তাহের সন্স ফ্যাশনস লিমিটেড, এফোরবি ওয়্যার্স লিমিটেড, জুমুন টেক্সটাইল লিমিটেড, ইউসুফ অ্যাপরেলস লিমিটেড, পাফ ফ্যাশন লিমিটেড, ফাইজা ফ্যাশন অ্যাপারেলস, মুন স্টার গার্মেন্টস, সি সোর অ্যাপারেলস লিমিটেড, হলমার্ক অ্যাপারেলস লিমিটেড, কেজিএম অ্যাপারেল, ট্রেডস্কান ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড ও সিটি সোয়েটার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড। চট্টগ্রামের দক্ষিণ আগ্রাবাদ ঠিকানার মদিনা এস্টাবলিশমেন্ট লিমিটেড ও পাহাড়তলীর রনসন নিটিং লিমিটেড কারখানা সীমিত পরিসরে চালু আছে মালিকানা পরিবর্তন করে।
২০টি প্রতিষ্ঠানের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিন সার্টিফিকেট) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে যাচাই করা হলে সেগুলো জাল বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সিটি সোয়েটার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, ট্রেডস্কান ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড, ওয়েবস ক্লদিং লিমিটেড, লাইসিউম ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, লেগুন ক্লদিং লিমিটেড, জুমুন টেক্সটাইল লিমিটেড, মদিনা এস্টাবলিশমেন্ট লিমিটেড, মুন ফ্যাশন লিমিটেড, আইই এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড এক্সপোর্ট লিমিটেড, স্টেজ টু লিমিটেড, কেজিএম অ্যাপারেল (প্রা.) লিমিটেড, ইউসুফ অ্যাপারেলস লিমিটেড, মন্ডিটেক্স ফ্যাশন লিমিটেড, বেউ মন্ডি গার্মেন্টস লিমিটেড, গাউস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইয়ান অ্যাপারেলস লিমিটেড, পাফ ফ্যাশন লিমিটেড, দ্য লাকি অ্যাপারেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, আরএএনএল ডিজাইনার্স লিমিটেড ও ড্রেস ডিজাইনার্স লিমিটেড।
এর পাশাপাশি ১২টি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে যাচাই করা হলে এর কোনোটিই চসিকের রাজস্ব বিভাগের ইস্যুকৃত নয় বলে নিশ্চিত করেছে চসিক কর্তৃপক্ষ। সিটি করপোরেশনে যাচাই করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে এবলি গার্মেন্টস, বাবুই নিট ফ্যাশন, পম্প অ্যান্ড ভেইলি লি, ইয়ান অ্যাপারেলস লি, গাউস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, মন্ডিটেক্স ফ্যাশন, বেউ মন্ডি অ্যাপারেল, তাহের সন্স ফ্যাশনস লিমিটেড, রেনল ডিজাইনার লিমিটেড, সিটি সোয়েটার ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, আইই এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড এক্সপোর্ট লিমিটেড ও জুমুন টেক্সটাইলস লিমিটেড। ট্রেড লাইসেন্সগুলোর ওপর হাতে লেখা, লাইসেন্স নাম্বার কিংবা নিচের দিকে যেসব কর্মকর্তার স্বাক্ষর দেয়া হয়েছে সেগুলো জাল।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আয়কর বিভাগের উপকমিশনার মো. আলাউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বেশ কয়েকটা পোশাক কারখানার সনদ এরই মধ্যে আমার নজরে এসেছে, যেগুলোতে আমার দেয়া স্বাক্ষর কিংবা অন্যান্য তথ্য জাল করা হয়েছে। নির্দিষ্ট তারিখ, প্রতিষ্ঠানের লোকেশন, সার্কেল এসব বিবেচনায় নিলে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সহজেই উদঘাটন করা যাবে।’
বেশকিছু পোশাক কারখানার উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা নাম না প্রকাশের শর্তে জানিয়েছেন, এবারের নির্বাচন নিয়ে খারাপ মোটিভ আছে। এটা শিল্পের জন্য মোটেও সুখকর হবে না। ভোটের যুদ্ধে জিততে মরিয়া হয়ে পড়ায় প্যানেল লিডারদের তত্পরতা নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করছে। বিজিএমইএর পদ-পদবি ব্যবহার করে শিল্পের স্বার্থে কাজ না করে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার সাধ অনেকের। যেসব কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিংবা অস্তিত্বই নেই সেসব কারখানার নাম বাদ দিতে হবে। রফতানিমুখী এ শিল্পের স্বার্থেই ভোটার তালিকা সংশোধন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ তালিকার ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হলে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়া তো প্রশ্নবিদ্ধ হবেই, শিল্পের জন্য হবে অশনিসংকেত।
এ বিষয়ে কথা বলতে বিজিএমইএর নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা জানিয়েছেন।
ফোরাম থেকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে অ্যারিয়ন ড্রেসের মোহাম্মদ আতিক, চিটাগং এশিয়ান অ্যাপারেলসের মোহাম্মদ আবদুস সালাম, ক্লিপটন অ্যাপারেলসের এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, ম্যাগি অ্যান্ড লিজ অ্যাপারেলসের এনামুল আজিজ চৌধুরী, মেলো ফ্যাশনসের শরীফ উল্লাহ, রিজি অ্যাপারেলসের মির্জা মো. আকবর আলী চৌধুরী, রেন্সকো সোয়েটারের মোহাম্মদ দিদারুল আলম, দ্য নিড অ্যাপারেলসের রিয়াজ ওয়েজ ও উল ওয়ার্ল্ডের খন্দকার বেলায়েত হোসেন নির্বাচন করছেন।
অন্যদিকে সম্মিলিত পরিষদে চট্টগ্রাম অঞ্চলে এএসআর অ্যাপারেলের এএম শফিউল করিম খোকন, অ্যামেকো ফ্যাব্রিকসের এম আহসানুল হক, ফোর এইচ অ্যাপারেলের মো. হাসান জেকি, এইচকেসি অ্যাপারেলের রকিবুল আলম চৌধুরী, লেগেসি ফ্যাশন্সের তানভীর হাবিব, এনএলজেড ফ্যাশনসের মোহাম্মদ মেরাজ-ই মোস্তফা, আরএসবি ইন্ডাস্ট্রিয়ালের অঞ্জন শেখর দাশ, টপ স্টার ফ্যাশনসের আবসার হোসেন ও ওয়েল ডিজাইনার্সের সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন।
২০১৯ সালে ফোরাম ও সম্মিলিত পরিষদ জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করে ৩৫টি পদের সবক’টিতে বিজয়ী হয়েছিল। এর আগে ২০১৩ সালে এ দুই প্যানেল প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিজিএমইএ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৯ সালের পর আবারো সমঝোতার নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করা হলেও শেষ মুহূর্তে স্বাধীনতা পরিষদের উত্থানে ভোটগ্রহণের বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়।
এ বিষয়গুলো আমরা বুঝি এবং জানি জানিয়ে বিজিএমইএ নির্বাচনের জোট সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, বিজিএমইএর নিয়ম ও সংবিধান অনুযায়ী ভোটার করতে তিনটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। একটি হলো সদস্যদের সাবস্ক্রিপশন হালনাগাদ থাকা, নবায়ন হওয়া ট্রেড লাইসেন্স ও ট্যাক্স ফাইল রক্ষণাবেক্ষণ করা। এ তিনটি নিশ্চিত হলেই ভোটারের যোগ্যতা নিশ্চিত হয়। যদিও কিছু কারখানা বন্ধ আছে, তারা ব্যবসায় নেই। কিন্তু বিজিএমইএর ভোটার হিসেবে তারা যেহেতু সাবস্ক্রিপশন হালনাগাদ করে রেখেছে, তাই বিজিএমইএর ভোটার হওয়ার যোগ্যতা তাদের রয়েছে। কোনো নথি জালিয়াতির তথ্য আমার জানা নেই।
এদিকে নির্বাচনের আরেক জোট ফোরামের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিজিএমইএ বর্তমান পর্ষদের পিআর কমিটির চেয়ারম্যান খান মনিরুল আলম শুভ বণিক বার্তাকে বলেন, বিজিএমইএর সংবিধান অনুযায়ী তারা ভোটার। হ্যাঁ, যদি ভোট দেয়ার অধিকার কেবল বৈধ রফতানিকারক ও কারখানা মালিকদের কাছে থাকত, সেটা হতো আরো ভালো উপস্থাপন।
এদিকে জালিয়াতির সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন ফোরামের প্যানেল লিডার এবিএম শামছুদ্দিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে বিজিএমইএর সংবিধান অনুযায়ী কারখানা সক্রিয় না থাকলেও সাবস্ক্রিপশন ফি নিয়মিত দেয়া থাকলে ভোটার হিসেবে গণ্য হন কারখানা মালিক।