দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি বলে পরিচিত তৈরি পোশাক শিল্পের ৪২ লাখ শ্রমিককে ২০২৬ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য বিমার আওতায় আনা যাবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা সহজীকরণের ধাপে ধাপে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যাবে। এর মধ্যে ২০২২ সালের পাঁচ লাখ, ২০২৩ সালে ১০ লাখ, ২০২৪ সালে ২০ লাখ, ২০২৫ সালে ৩০ লাখ ও ২০২৬ সালের মধ্যে সকল শ্রমিককে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনা যাবে। রোববার (১৪ মার্চ) রাজধানীর মহাখালীর ব্রাক সেন্টারে আয়োজিত ‘তৈরি পোশাক খাতের (আরএমজি) শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমা নীতিমালা ও প্রয়োজনীয়তা’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক গবেষণা প্রবন্ধে এসব তথ্য জানানো হয়। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধটি উপস্থাপন করেন ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, ঢাবির স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণায় দেখা গেছে দেশের রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে তৈরি পোশাক থেকে। আর এ খাতে কাজ করেন প্রায় ৪২ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে নারী শ্রমিকের সংখ্যাই বেশি। তাদের ৪৩ শতাংশ বছরে নানা অসুখে ভোগেন। মোট শ্রমিকের ১ শতাংশ আছেন স্বাস্থ্যবিমার আওতায়। শতকরা ৪০ জন শ্রমিক উচ্চমূল্যের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারেন না। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিমা সুবিধায় আছেন ৩৫ কারখানার ৫৮ হাজার ২৬১ শ্রমিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করে জানানো হয়, তৈরি পোশাক শ্রমিকদের উপযুক্ত সুবিধা প্যাকেজের আওতায় আনতে হলে বছরে প্রতিজনের জন্য ১ হাজার টাকা প্রিমিয়াম প্রয়োজন হবে। উল্লেখিত প্রিমিয়ামে ৩৬৫ টাকা শ্রমিক, ৩৬৫টাকা মালিক এবং বাকি ২৭০ টাকা সরকার বহন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সব শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে আগামী ৪-৫ বছরের মধ্য স্বাস্থ্যবিমার আওতায় আনার আহ্বান জানানো হয়। এতে বলা হয়, ‘স্বাস্থ্যবিমা ব্যবস্থাপনা ইউনিট’ অথবা ‘বিমা তহবিল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান’ গঠনের মাধ্যমে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের জন্য প্রচলিত পাইলট স্বাস্থ্যবিমা স্কিমকে সমন্বিত করে পর্যায়ক্রমে সব তৈরি পোশাক শ্রমিকদের বিমার আওতায় আনার উদ্যোগ শুরু করা এখনই প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল জানান, পোশাক শ্রমিকদের যথাযথ স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এবং এনজিও দীর্ঘদিন ধরে ‘তৈরি পোশাক শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা’ নামে পাইলট প্রোগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। দেখা গেছে, স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণের ফলে তাদের চিকিৎসা সেবা নেওয়া সহজতর হওয়ায় স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবায় নিজস্ব খরচ কমে গেছে। তাছাড়া স্বাস্থ্যবিমায় অংশগ্রহণের ফলে শ্রমিকের অসুস্থতাজনিত অনুপস্থিতি কমে যাওয়ার কারণে কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সরকারের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. শাহাদাত হোসাইন মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিমা কার্যকর করা বড় একটি চ্যালেঞ্জ। তবে এটি অসম্ভব নয়, সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যবিমার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছেন। তার নেতৃত্বে আমরা একটি সুদিনের অপেক্ষায় আছি।’ অনুষ্ঠানে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল এবং আরবান ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের ব্র্যাকের পরিচালক ড. মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘গার্মেন্টস কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমা প্রদানে দুটি মডেল হতে পারে। প্রথমত দেখতে হবে, এটা কি রেভিনিউ সেটআপ? নাকি প্রজেক্ট সেটআপ? যদি রেভিনিউ হয়ে থাকে তাহলে বছরখানেকেও এর কাজ শেষ হবে কিনা সংশয় রয়েছে। অন্যদিকে এটা যদি প্রজেক্ট সেটআপ হয়, সেক্ষেত্রে প্রজেক্ট পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান দ্রুত সেটা করে ফেলতে পারবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিমা সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে। চিকিৎসকরা বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যখন স্বাস্থ্যবিমার আওতায় কোনো রোগী পায় তখন তারা গুরুত্ব দিতে চায় না। এক্ষেত্রে বিমায় সেবা গ্রহণকারীকে কিছুটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সেক্ষেত্রে বিমা গ্রহীতারা যথাযথ সেবা পাচ্ছেন কিনা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’ অনুষ্ঠানে গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক তাহমিনা হক বলেন, ‘গার্মেন্টস শ্রমিকদের অধিকাংশই স্বাস্থ্যবিমা সম্পর্কে জানেন না। সে ক্ষেত্রে শ্রমিকদের মাঝে এটা নিয়ে কাজ করা উচিত। তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা উচিত। তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টস কর্মীরা সাধারণত কম অসুস্থ হয়। তবে কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকরা অসুস্থ হয় অতিরিক্ত ডিউটির কারণে। নির্দিষ্ট আট ঘণ্টার বাইরেও তাদের অতিরিক্ত কাজের চাপ দেওয়া হয়। শ্রমিকরাও চাকরি চলে যাওয়ার ভয় ডিউটি পালন করতে বাধ্য হয়।’ অনুষ্ঠানে রিসার্চ, ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (আরটিএম) ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ জগলুল পাশা বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিমা প্রজেক্ট অবশ্যই সরকারি ব্যবস্থাপনায় হওয়া উচিত। না হয় এটা নিয়ে বড় ধরনের ব্যবসা শুরু হয়ে যাবে। অনুষ্ঠানে বিজেএমইএ হেলথ সেন্টারের চেয়ারম্যান হানিফুর রহমান লোটাস বলেন, ‘করোনাভাইরাসের সময় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। ফলে গার্মেন্টসগুলোয় করোনায় মৃত্যুর হার শূন্যভাগ। মালিকদেরই এখনও স্বাস্থ্যবিমা করা হয়নি তাহলে শ্রমিকদের কিভাবে স্বাস্থ্যবিমা হবে? তবে আমরা চেষ্টা করছি। যদিও বিষয়টা অনেক জটিল এবং কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি সব মালিকদের ঐক্যবদ্ধ করেই গার্মেন্টস কর্মীদের স্বাস্থ্যবিমার অধীনে নিয়ে আসতে।’