করোনা ভাইরাস মহামারীর আগে থেকেই দেশের তৈরী পোশাক শিল্পখাত নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। গত বছর করোনা ছড়িয়ে পড়ার আগেই ২০১৯ সালের শেষ ৬ মাসে ৬৯টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল একটি জাতীয় দৈনিকে। করোনার সংক্রমন ও লকডাউনের কারণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে চরম অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতা ও ব্র্যান্ড কোম্পানীগুলো শত শত ক্রয়াদেশ বাতিলের কারণে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। লোকসান দিয়ে চালু রাখতে ব্যর্থ হয়ে অনেক কারখানা মালিক ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এহেন বাস্তবতায় সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা ও সহজশর্তে ঋণ প্যাকেজ বড় বড় কারখানা পেলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো রক্ষায় তেমন কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি। কয়েক দফায় ঘোষিত এক লাখ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও এর বড় অংকের একটি অংশ গার্মেন্ট খাতের জন্য বরাদ্দ করা হলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের কারখানা এর সুফল তেমন পায়নি। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত রির্পোটে করোনা পেন্ডেমিকের কারণে ক্রয়াদেশ বাতিল, কঠিন শর্ত আরোপ, মূল্য পরিশোধে অস্বাভাবিক দীর্ঘ কালক্ষেপণ এবং করোনায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়াসহ নানাবিধ কারণে তিন শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে। এর ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার ৫০ হাজারের বেশি শ্রমিক সরাসরি কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়েছে। অন্যদিকে সামগ্রিকভাবে ৩ লক্ষাধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব পড়েছে। দেশে করোনাভাইরাস মহামারীর মাত্রা ও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকলেও ক্রেতাদেশগুলোতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাব সক্রিয় থাকায় ফ্যাক্টরিগুলো সংকটে পড়েছে। অর্ধেক বা তারও কম শ্রমিক নিয়ে কারখানা সচল রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে এ খাতের কর্মসংস্থানের উপর। কেস স্টাডিতে দেখা যায়, গাজীপুরে ২২ বিঘা জমির উপর ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি পোশাক কারখানায় ১৪০০ শ্রমিক কাজ করত, পেন্ডেমিক শুরুর ৬ মাসের মাথায় উদ্যোক্তা ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হলে ১৪০০ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে কারখানাটি চালুর উদ্যোগ নেয়া হলেও ক্রেতাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসায় দেশীয় ক্রেতাদের জন্য সীমিত পরিসরে মাত্র ৭০ জন শ্রমিক নিয়ে ফ্যাক্টরি চালু করা হয়েছে। একইভাবে গার্মেন্ট সেক্টরের ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ খাতেও লাখ লাখ কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। গার্মেন্টস সেক্টরের হাজার হাজার ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার হাজার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ও লাখ লাখ কর্মসংস্থান বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে মুক্ত করতে, দেশের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় এ খাতটি রক্ষায় সরকারের আরো কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তৈরী পোশাক খাতের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানাগুলো। এসব কারখানার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রক্ষা করা না গেলে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। করোনাকালীন বাস্তবতায় শিল্পখাতের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের লক্ষাধিক কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ বেশিরভাগ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য তেমন কাজে আসেনি। রাষ্ট্রায়াত্ব ব্যাংকগুলো থেকে বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান ও লোকসানি রাষ্ট্রায়াত্ব কোম্পানী হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলেও বেসরকারি ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারিরা বঞ্চিত হয়েছে। এক রিপোর্টে দেখা যায়, রাষ্ট্রায়াত্ব সোনালী ব্যাংক থেকে আরেক রাষ্ট্রায়াত্ব প্রতিষ্ঠান বিমান বাংলাদেশ এক হাজার কোটি টাকা করোনা প্যাকেজ থেকে নিয়ে গেছে। অথচ এই টাকা দিয়ে শতাধিক ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান রক্ষা করা সম্ভব ছিল। বৃহৎ ও বহুজাতিক কোম্পানীগুলো টিকে থাকার নানা ব্যবস্থা ও উদ্যোগ থাকলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কারখানাগুলোর বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের যথাযথ পদক্ষেপ থাকা জরুরী। এ ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের সাথে বিজিএমইএ, ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট ক্রেতা ও কনসোর্টিয়ামের কাজের একটি সমন্বয় থাকা দরকার। আমাদের জাতীয় অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বিশেষ অবদান রাখা ক্ষুদ্র ও মাঝারি গার্মেন্ট কারখানাগুলোকে প্রণোদনা বা স্টিমুলাস প্যাকেজের সুবিধা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে শর্ত শিথিল ও সহজ করার উদ্যোগ নিতে হবে।