তৈরি পোশাক বাংলাদেশে রফতানি আয়ের অন্যতম শীর্ষ খাত। গত বছর করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে ভালভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছিল খাতটি। কিন্তু এবার দ্বিতীয় ধাপে দেশে রেকর্ড মাত্রায় করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় শঙ্কা বাড়ছে তৈরি পোশাক শিল্পে। ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন করে লকডাউনে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন রফতানিকারকরা। তারা বলছেন, এখনও বড় মাত্রায় পোশাক ক্রয়াদেশ বাতিল বা স্থগিত হয়নি। তবে যে কোন সময় পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার আশঙ্কায় আছেন তারা। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গতবছর (২০২০ সাল) জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বৈশ্বিক পোশাক আমদানি ২৩ শতাংশ কমে যায়। করোনায় দেশে দেশে লকডাউনের কারণে মানুষ পোশাক কেনা কমিয়ে দেয়। ফলে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে জমে পোশাকের স্তূপ। এতে অনেক ব্র্যান্ড কারখানা আগের কার্যাদেশ বাতিল করে, অনেকে দামও কমিয়ে দেয়। তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ করোনায় পোশাক খাতে একটি ক্ষতির হিসাব করেছে। তারা বলছেন, গত বছর করোনা শুরুর পর মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ৩.৮১ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার স্থগিত হয়। পরবর্তীতে একই বছরের জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত স্থগিত হওয়া অর্ডারের শতকরা ৯০ ভাগ ফিরে আসে। ৫০ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার শেষ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি। এর পর গত কয়েক মাসে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি অনেকাংশেই কমে যায়। কেভিড-১৯সহ বিভিন্ন কারণে প্রতি মাসেই কমছে পোশাক রফতানি। মাসে এখন গড়ে ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়ে বিশ্বব্যাপী তৈরি পোশাকের দাম কমেছে ৪ শতাংশের মতো। যা এখন পর্যন্ত খুব একটা উন্নতি হয়নি। যদিও পোশাক রফতানি করে লাভ হয় গড়ে শতকরা দুই-তিন ভাগ। ফলে লাভ কমে গেছে বা লোকসান বেড়েছে বলে জানিয়েছে বিজিএমইএ। নুতন করে বিশ্বের বেশ কিছু দেশে আবারও লকডাউন দেয়ায় সেখানকার খুচরা ক্রেতারা পোশাক কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাই বায়াররাও সতর্ক। তারা আগে যদি একসঙ্গে এক লাখ পিস অর্ডার করতেন এখন পাঁচবারে অর্ডার করছেন। এখানে কারখানাগুলো সাধারণত তিন মাস আগে অর্ডার পেত। কিন্তু এখন সেই লিড টাইম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে কারখানাগুলোকে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন করতে হচ্ছে। হালনাগাদ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর করোনার সংক্রমণ ছিল অন্য যে কোন দেশের চেয়ে বেশি। সে কারণে ২০২০ সালে দেশটিতে তৈরি পোশাক আমদানি এক-চতুর্থাংশ কমে যায়। তবে করোনা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে আবারও দেশটিতে পোশাক রফতানি বাড়ছে। সেই সুফল বাংলাদেশও পেয়েছে। তবে নতুন করে সংক্রমণ বাড়ায় দেশটিতে পোশাক রফতানি নিয়ে আবারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অটেক্সার তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা ১০০ কোটি ডলার বা সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার পোশাক রফতানি করেছে। এই আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ কম। এই বাজারে চীন ও ভিয়েতনামের পর বাংলাদেশ তৃতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ। গত বছর একপর্যায়ে চীনকে ছাড়িয়ে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক হলেও পরিস্থিতি আবার বদলেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে চীন ২৪৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ২২ শতাংশ কম। অন্যদিকে ভিয়েতনাম গত জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ২০৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রফতানি করেছে। গত বছরের প্রথম দুই মাসে দেশটি ২৩৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছিল। সেই হিসাবে চলতি বছর তাদের রফতানি কমেছে ১২ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এদিকে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পোশাক রফতানিও কমেছে। চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে ভারত ৫৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করলেও গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২১ দশমিক ৮৯ শতাংশ কম। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চতুর্থ সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক দেশ। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া রফতানি করেছে ৫৫ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। তাদের রফতানি কমে গেছে ২৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক এ বিষয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এখনও শ্লথ। দেশটির ব্র্যান্ড ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান সব ধরনের পোশাক নিলেও পরিমাণে কম। বিপুলসংখ্যক মানুষ টিকা নিলেও দেশটিতে নতুন করে আবার সংক্রমণ বাড়ছে। আসলে করোনার নিত্যনতুন ধরনের কারণে পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। বিকেএমইএর সাবেক এই সভাপতি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে ব্যবসায় ঘুরে দাঁড়াতে আরও বেশি সময় লাগবে। কারণ, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো ছয়/সাত মাস পরের অবস্থা কী হবে, সেই পূর্বাভাস দেখে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই দ্রুত করোনা পরিস্থিতি উন্নতি না হলে তৈরি পোশাক রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। যদিও ক্রেতারা সে ধরনের কোন বার্তা এখনও দেয়নি।