প্রায় দুশো বছর আগে ঢাকাই মসলিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দামী কাপড়। কিন্তু তার পর এটা পুরোপুরি হারিয়ে গেছে। ঢাকায় এখনো জামদানি নামে মসলিনের শাড়ি তৈরি হয় বটে – কিন্তু তার সাথে দুশো বছর আগের ঢাকাই মসলিনের অনেক তফাত। সেই মসলিন তৈরির পদ্ধতি ছিল একেবারে অন্যরকম – তাতে ব্যবহৃত হতো বিশেষ ধরনের তুলা – যা এখন আর পাওয়া যায় না। কীভাবে বিলুপ্ত হলো প্রাচীন ঢাকাই মসলিন? একে কি আবার পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব?
মসলিনের স্বচ্ছতা ছিল কেলেংকারির বিষয়
অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপে শুরু হয়েছিল এমন এক নতুন ফ্যাশন – যা আবার জন্ম দিয়েছিল এক আন্তর্জাতিক কেলেংকারির। সমাজের একটি গোটা শ্রেণীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল যে তারা নগ্ন অবস্থায় জনসমক্ষে উপস্থিত হচ্ছেন এর জন্য দায়ী জিনিসটি ছিল ঢাকাই মসলিন – এক ধরনের দামী কাপড় – যা তৎকালীন ঔপনিবেশিক ভারতের বেঙ্গল প্রদেশের ঢাকা শহর থেকেই আসতো – যা আজকের বাংলাদেশের রাজধানী। মসলিনের শাড়ি এখনো বাংলাদেশে তৈরি হয় – যার নাম জামদানি – তবে আধুনিক কালের মসলিনের সাথে সেই প্রাচীন যুগের মসলিনের অনেক তফাৎ। সেকালে মসলিন তৈরি হতো ১৬ ধাপের এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। তাতে ব্যবহৃত হতো এক দুর্লভ জাতের তুলা থেকে তৈরি সূতা। সেই তুলা জন্মাতো মেঘনা নদীর পাড়ে। সে যুগে মসলিনের মর্যাদা ছিল ধনরত্নের মতই। আর ঢাকাই মসলিনের সমাদর ছিল সারা পৃথিবী জুড়ে। সেই সুখ্যাতি তৈরি হয়েছিল হাজার হাজার বছর ধরে। প্রাচীন গ্রিসে মনে করা হতো মসলিনই হচ্ছে দেবীদের মূর্তিকে পরানোর উপযুক্ত কাপড় । দূরদূরান্তের বহু রাজ্যের রাজারা পরতেন এই মসলিন। আর ভারতের মোগল রাজবংশে তো অনেক প্রজন্ম ধরে পরা হয়েছিল মসলিনের পোশাক।
সে যুগেও মসলিন ছিল অনেক রকমের। তবে এর মধ্যেও সবচেয়ে সূক্ষ্ম আর দামী মসলিনের প্রশংসা করে নানা নাম দিতেন রাজকীয় কবিরা। একটি নাম ছিল ‘বাফৎ হাওয়া’ – অর্থাৎ ‘বাতাস দিয়ে বোনা কাপড়’। নামেই বোঝা যাচ্ছে, এসব উচ্চস্তরের মসলিন ছিল হাওয়ার মতই হালকা আর নরম। একজন ভ্রমণকারী বর্ণনা করেছেন তিনশ’ ফুট লম্বা (৯১ মিটার) মসলিনের থান গোটানো-অবস্থায় এতই নরম ছিল যে তা একটা আংটির মধ্যে দিয়ে গলে যেতো। আরেকজন লিখেছেন ৬০ ফুট লম্বা একটি মসলিন ভাঁজ করে রাখা যেতো একটি নস্যির কৌটায়। তার ওপরে – ঢাকাই মসলিন ছিল একেবারে স্বচ্ছ। ঐতিহ্যগতভাবে অত্যন্ত দামী এই কাপড় দিয়ে তৈরি হতো শাড়ি আর পুরুষদের জামা। কিন্তু ব্রিটেনে এই মসলিন আসার পর তা সমাজের বিত্তশালীদের পোশাকের ধরন পাল্টে দিল। তাদের মধ্যে এমন এক ধরনের হালকা লম্বা ধরনের ‘শেমিজ-গাউন’ পোশাক জনপ্রিয় হলো – যা অনেকটা তারও আগের যুগে অন্তর্বাস বলে গণ্য হতো।
সেযুগে ব্যঙ্গাত্মক ছবি এঁকে জনপ্রিয় হয়েছিলেন আইজাক ক্রুইকশ্যাংক বলে একজন শিল্পী। তার একটি প্রিন্ট আছে যার শিরোনাম “১৮০০ সালের শীতের পোশাকে প্যারিসের মহিলারা”। এতে কয়েকজন মহিলাকে দেখা যাচ্ছে তারা উজ্জ্বল রঙের লম্বা ছাঁটের মসলিনের পোশাক পরে আছেন। সে পোশাক এতই স্বচ্ছ যে তাদের নিতম্ব, স্তনের বোঁটা, এমনকি যৌনকেশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তার পরেও ঢাকাই মসলিন ছিল ‘হিট’ পোশাক – অবশ্য তাদের জন্য যাদের এটা কেনার মত অর্থ ছিল। সে যুগে সবচাইতে দামী পোশাক ছিল মসলিন। এর বিখ্যাত ভক্তদের মধ্যে ছিলেন ফ্রান্সের রানি মেরি আঁতোয়ানেৎ, ফরাসী সম্রাজ্ঞী জোসেফিন বোনাপার্ত, এবং লেখিকা ইংরেজ লেখিকা জেন অস্টেন। কিন্তু মসলিন সেই ‘এনলাইটমেন্ট’ যুগের ইউরোপে যেমন হঠাৎ চমক সৃষ্টি করেছিল – তেমনি হঠাৎ করেই তা আবার অদৃশ্যও হয়ে গেল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে পুরো পৃথিবী থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় ঢাকাই মসলিন। তার যে ক’টি নমুনা টিকে ছিল – তার স্থান হয়েছে ইউরোপের জাদুঘরে, বা মূল্যবান ব্যক্তিগত সংগ্রহে। মসলিন বোনার যে জটিল প্রক্রিয়া – তা-ও লোকে এক সময় ভুলে গেল। শুধু তাই নয় – মসলিন বানাতে যে “ফুটি কার্পাস” নামে বিশেষ ধরনের তুলা ব্যবহৃত হতো – হঠাৎ করে তাও গেল বিলুপ্ত হয়ে। এই ফুটি কার্পাসের বোটানিক্যাল নাম ছিল গোসিপিয়াম আরবোরেটাম ভার নেগ্লেক্টা। এটা ছাড়া আর কোন তুলা দিয়ে মসলিন তৈরি হতো না। প্রশ্ন হলো, কেন আর কি করেই বা এমন হলো? একে আবার ফিরিয়ে আনার কি কোন উপায়ই নেই?
এক নাজুক আঁশ
ঢাকাই মসলিনে ব্যবহৃত তুলার গাছ জন্মাতো মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষা মাটিতে। এই মেঘনা হচ্ছে গঙ্গা অববাহিকার সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটি। এর পাতা দেখতে অনেকটা মেপলের মত। প্রতি বসন্তকালে ধূসর পলিমাটিতে এই গাছ জন্মাতো, আর পূর্ণবয়স্ক গাছে বছরে দু’বার একটি করে ড্যাফোডিলের মত হলুদ রঙের ফুল হতো। সেই ফুল থেকে পাওয়া যেতো তুষারশুভ্র তুলা। এই তুলা কোন সাধারণ তুলা নয়। পৃথিবীতে এখন যে তুলা উৎপাদিত হয় – তার ৯০ শতাংশই হচ্ছে মধ্য আমেরিকা থেকে আসা গোসিপিয়াম হিরসুটাম জাতের তুলা। তার আঁশ হচ্ছে সরু আর লম্বা আকৃতির।
কিন্তু ফুটি কার্পাস থেকে যে সূতা হয় তা খাটো আর মোটা ধরনের, তার আঁশ সহজেই আলগা হয়ে যায়। এ বর্ণনা শুনলে মনে হতে পারে, এ তুলা কোন কাজে লাগার মতো নয়। আসলেই, ছোট আঁশওয়ালা এই তুলা মেশিন ব্যবহার করে সস্তা কাপড় বোনার উপযোগী ছিল না। এটা হাতে ধরে কাজ করা কঠিন, একে পেঁচিয়ে সূতা বানাতে গেলে খুব সহজেই ছিঁড়ে যায়। কিন্তু স্থানীয় লোকেরা এই তুলাকেই কাপড় বোনার উপযুক্ত করে তুললেন – তাদের নিজস্ব কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করে । পুরো প্রক্রিয়াটাতে ১৬টি ধাপ আছে। সেই টেকনিক এতই বিশেষ ধরনের যে তা করতে জানতেন শুধু ঢাকার কাছে অন্য আরেকটি গ্রামের লোকেরা। এতে যোগ দিতেন গ্রামের ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ সবাই। প্রথমে সেই তুলোর দলাগুলো পরিষ্কার করা হতো বোয়াল মাছের দাঁত দিয়ে – যে রাক্ষুসে মাছ তখন ওই এলাকার নদীতে বা বিলে পাওয়া যেতো।
এর পর সেই তুলাকে চরকা দিয়ে সূতায় পরিণত করা হয়। এই তুলার আঁশ যেহেতু ছোট ছোট তাই একে টেনে লম্বা করার জন্য বাতাসে উচ্চ আর্দ্রতা দরকার হতো। সে জন্য এই কাজটা করা হতো নৌকার ওপর, ভোরে বা সন্ধ্যায় যখন বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকে। চরকা কাটার কাজ করতেন দক্ষ অল্পবয়সী মহিলারা। কারণ এই সূতা এতই সূক্ষ্ম হতো যে বয়স্ক মানুষরা তা দেখতে পেতেন না। “এভাবে বোনা সূতাতে একটা রুক্ষতা থাকতো -যা হাতে ধরলে একটা চমৎকার অনুভূতি হতো” – বলছিলেন ডিজাইন ইতিহাসবিদ সোনিয়া এ্যাশমোর, যিনি ২০১২ সালে মসলিনের ওপর একটি বই লিখেছেন। এর পর হচ্ছে আসল কাজটা – সেই সূতা দিয়ে কাপড় বোনা।