শিল্প-কারখানা অধ্যুষিত জেলা গাজীপুরে দেশের রফতানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সদস্য কারখানা আছে মোট ৭৪১টি। এর মধ্যে ৭১৩টি কারখানা গত মার্চে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করেছে। বাকি ২৮টি কারখানা গতকাল পর্যন্ত বেতন পরিশোধ করেনি। পোশাক শিল্প মালিকদের আরেক সংগঠন বিকেএমইএর সদস্যদের মধ্যে মার্চের বেতন পরিশোধ করেনি এমন কারখানার সংখ্যা ছয়টি।
এ হিসাব কেবল বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য কারখানাগুলোর। সব মিলিয়ে দেশের ছয় শিল্প এলাকায় মার্চের বেতন পরিশোধ করেনি এমন কারখানা সংখ্যা ১৫৪টি। ফলে বেতন-ভাতার দাবিতে এসব কারখানার শ্রমিকরা যেকোনো সময় বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু মার্চের বকেয়া নয়, আসন্ন ঈদের আগে চলমান এপ্রিলের বেতন ও উৎসব ভাতা পরিশোধেও অনেক কারখানা অসমর্থ হতে পারে। শিল্প পুলিশের হিসাবে দেশের ছয় শিল্প এলাকায় অসমর্থ হতে পারে এমন কারখানা সংখ্যা ৫৩৮টি।
আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা—এ ছয়টি এলাকা শ্রমঘন বলে বিবেচিত, যার আইন-শৃঙ্খলা তদারকির দায়িত্বে আছে শিল্প পুলিশ। সংস্থাটির তথ্য মতে, এসব এলাকায় বস্ত্র, তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য, আসবাব, সেলফোন সংযোজন, ওষুধ ও অন্যান্য খাত মিলিয়ে মোট কারখানা আছে ৭ হাজার ৯৮২টি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে শিল্প পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, অনেক কারখানা মার্চের বেতন পরিশোধ করেনি। কভিডকালের প্রেক্ষাপটে আরো অনেক কারখানা আছে, যারা ঈদের আগে বেতন-বোনাস পরিশোধে অসমর্থ হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই যেকোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে আগামী সপ্তাহের প্রথমেই আলোচনা করে কৌশল নির্ধারণ করা হবে।
শিল্প পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়া-সাভার এলাকায় সব খাত মিলিয়ে মোট কারখানা আছে ১ হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধে অসমর্থ হতে পারে এমন কারখানার সংখ্যা মোট ১৪১টি। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ৬২, বিকেএমইএর ১৯ ও পোশাক খাতের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বস্ত্র শিল্প মালিক সংগঠন বিটিএমএ সদস্য সংখ্যা পাঁচটি। বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেপজা) আওতায় থাকা কারখানার সংখ্যা নয়টি। এছাড়া বেতন-ভাতা পরিশোধ অসমর্থ হতে পারে অন্যান্য খাতে এমন কারখানা আছে ৪৬টি।
গাজীপুর এলাকায় মোট কারখানা আছে ১ হাজার ৯৭২টি। এর মধ্যে ২২২টি কারখানা ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধ করতে পারবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অসমর্থ হতে পারে এমন কারখানাগুলোর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য ১৩৬টি, বিকেএমইএর ২৩টি ও বিটিএমএর ১৫টি। এ এলাকায় নেই বেপজার আওতায় থাকা কোনো কারখানা। তবে অন্যান্য খাতের ৫০টি কারখানাও রয়েছে বেতন-ভাতা পরিশোধে অসমর্থ হওয়ার তালিকায়।
বন্দর নগরী চট্টগ্রামে মোট কারখানা ১ হাজার ২৫০টি। সেখানে ৯১টি কারখানা বোনাস ও বেতন দিতে পারবে না বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছে শিল্প পুলিশ। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা ৪১টি, বিকেএমইএর ছয়টি ও বিটিএমএর সদস্য কারখানা রয়েছে তিনটি। বেপজার আওতায় থাকা এমন কারখানার সংখ্যা ১৬টি। বেতন-ভাতা পরিশোধে অসমর্থ হতে পারে অন্যান্য খাতে এমন কারখানা আছে ২৫টি।
নারায়ণগঞ্জে মোট কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ৫৮৪টি। বেতন-বোনাসের সম্যস্যায় পড়তে পারে ৬৫টি কারখানা। এর মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ১৫, বিকেএমইএর ২৮, বিটিএমএর পাঁচটি। এ এলাকায় বেপজার আওতাভুক্ত কোনো কারখানা নেই। তবে অন্যান্য খাতের ১৭টি কারখানা আছে যারা বেতন-বোনার পরিশোধে অসমর্থ হতে পারে।
ময়মনসিংহ শিল্প এলাকায় মোট ১৩১টি কারখানার মধ্যে ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ও বোনাস পরিশোধে অসমর্থ হতে পারে ১৭টি। এখানে বিজিএমইএর সদস্য কারখানা সংখ্যা সাতটি ও বিটিএমএর সদস্য সংখ্যা পাঁচটি। তবে বিকেএমইএর কোনো কারখানার বেতন-ভাতা দিতে সমস্যা হওয়ার শঙ্কা নেই। এছাড়া অন্যান্য খাতের পাঁচটি কারখানায় বেতন বোনাস নিয়ে সমস্যা হতে পারে।
খুলনায় মোট কারখানার সংখ্যা ৭২৪টি। এর মধ্যে কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষেরই বেতন-ভাতা পরিশোধে অসমর্থ হওয়ার শঙ্কা নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প কেন্দ্রীভবনের কারণেই ছয় শিল্প এলাকায় একক খাতভিত্তিক কারখানার সংখ্যা বেশি। ফলে বস্ত্র ও পোশাক খাতের কারখানা আধিক্য আছে। বেতন বোনাস পরিশোধের চিত্রেও কেন্দ্রীভবনের প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। ছয় শিল্প এলাকায় ৪০ থেকে ৪১ লাখ শ্রমিক বিভিন্ন খাতের কারখানাগুলোতে কাজ করছেন।
বরাবরের মতো এবারো ঈদুল ফিতরের আগে সার্বিক শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আলোচনায় বসেছেন শিল্প খাতসংশ্লিষ্টরা। গতকাল সরকার-মালিক-শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ কমিটির (টিসিসি) ৬৭তম সভা ও তৈরি পোশাক খাতের টিসিসি কমিটির অষ্টম সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ১০ মের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস পরিশোধের দিকনির্দেশনা দেয়া হয়।
১০ মের মধ্যে গার্মেন্টসসহ সব সেক্টরের শ্রমিকদের ঈদুল ফিতরের বোনাস ও এপ্রিলের বেতন-ভাতা পরিশোধের আহ্বান জানান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের স্বার্থে করোনা মহামারীর এই দুর্যোগকালে শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কলকারখানার উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। যদি কোনো কারখানার শ্রমিকদের মার্চের বেতন বকেয়া থাকে সেগুলো ঈদের আগেই পরিশোধ করতে হবে। এছাড়া সুবিধা মতো জোনভিত্তিক ছুটির ব্যবস্থা করতেও মালিকদের পরামর্শ দেন তিনি।
এ সময় মালিক-শ্রমিকদের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের জন্য কভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকাদানের বিশেষ উদ্যোগ নিতে প্রতিমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জানান, শ্রমিকদের টিকার আওতায় নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানো হবে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, শ্রমিকদের কঠোর স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে। কারণ ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতন থাকলে দেশের সবাই নিরাপদ থাকবে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলায় সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।