বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে ‘থার্ড প্রোগ্রামেটিক জবস ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট (ডিপিসি)’ এর আওতায় ২৫ কোটি ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক। তবে এ ঋণ পেতে বেশকিছু বিষয় নিশ্চিত করতে হবে সরকারকে। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে একটি ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এজন্য একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করা হয়েছে। সেটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানোর আগে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের মতামত নেওয়া হবে। এরপর প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি করা হবে। বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবিত ঋণের ক্ষেত্রে আইডিএ রেগুলার টার্মস প্রযোজ্য হবে। এ ঋণ ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ৩০ বছরে পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার হবে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ, সার্ভিস চার্জ শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ এবং অনুত্তোলিত অর্থেও ওপর কমিটমেন্ট চার্জ শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ। সূত্র জানায়, সরকার দেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন কর্মসংস্থানের সুযোগ ও পরিবেশ তৈরিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগ/সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সহায়ক কিছু নীতি কৌশল/বিধিবিধান সংস্কার ও আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এসব উদ্যোগ ও সংস্কার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাং ২০১৮-২০১৯ থেকে তিনি অর্থবছরে মোট ৭৫ কোটি মার্কিন ডলারের ডিপিসি ঋণ সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে। সূত্র জানায়, এই ডিপিসি ঋণের অংশ হিসেবে বিশ্বব্যাংক ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ২৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং ২০১৯-২০২০ অর্থবছরের ডিপিসি-২ এর আওতায় আরো ২৫ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২০-২০২১ অর্থবছরে প্রস্তাবিত ডিপিসি-৩ এর আওতায় বাকি ২৫ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ বিশ্বব্যাংকের বোর্ড মিটিংয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত ডিপিসি-৩ এর আওতায় করোনাজনিত ক্ষতি পূরণের লক্ষ্যে কয়েকটি সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে, যা শ্রমিকদের জীবন ও জীবিকার ক্ষয়-ক্ষতি রোধসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকেও দ্রুত ক্ষয়-ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। জবস ডিপিসি-৩ এর আওতায় তিনটি স্তম্ভের মাধ্যমে বিনিয়োগ পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রম বাজার উন্নয়ন এবং মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হবে।
স্তম্ভগুলোর মধ্যে আছে—
স্তম্ভ ‘ক’—বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের পরিবেশ আধুনিকায়ন:
এর মাধ্যমে প্রচলিত তৈরি পোশাক খাতের বাইরে বেসরকারি বিনিয়োগের সামগ্রিক পরিবেশের উন্নতির মাধ্যমে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদী কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তৈরি করা হবে। তৈরি পোশাক খাতের গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে বাংলাদেশের সুসংহত অবস্থানের কারণে গত দুই দশকে প্রায় ৪০ লাখ কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, যার একটি বড় অংশ মহিলা শ্রমিক। তৈরি পোশাক খাতের বাইরে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ তৈরি করতে পণ্য ও বাজার উভয় ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু এসব খাতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক বিধি-নিষেধের কারণে কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা যাচ্ছে না। স্তম্ভ ‘ক’ রপ্তানি ও বিনিয়োগের ওপর জোর দেওয়াসহ বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে প্রচলিত বিধিবিধান সংস্কারের বাস্তবায়নকে সমর্থন করে। এ বিষয়ে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এর মধ্যে নতুন ব্যবসা শুরু এবং পরিচালন করার জন্য ৩৫টি মূল নিয়ন্ত্রক সেবা প্রক্রিয়া সুবিন্যস্ত করে একত্রিত করা, নতুন শুল্ক আইন কার্যকর করার মাধ্যমে বাংলাদেশ সিঙ্গেল উইন্ডো’র কার্যক্রম শুরু করতে আইনি বিধান গ্রহণ এবং পরিবেশগত ও সামাজিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি নিশ্চিত করার জন্য ‘কি অ্যাসেসমেন্ট গাইডলাইন’ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন। সূত্র জানায়, এসব প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত হলে তা বিনিয়োগ পরিবেশ, রপ্তানি বৃদ্ধি এবং পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমিয়ে শিল্পের সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে, যা বিশ্বব্যাপী করোনা পরবর্তী বৈশ্বিক চাহিদা বাড়ার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
স্তম্ভ ‘খ’—শ্রমিকদের সুরক্ষা ও অভিঘাত মোকাবিলায় সক্ষমতা জোরদার করা:
এতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের সার্বিক সুরক্ষা বৃদ্ধি এবং কোভিড-১৯ ও এ ধরনের ভবিষ্যত সংকট মোকাবিলায় সরকারের সুরক্ষা বেষ্টনীকে শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ শ্রমিক এখনও যথাযথ পেশাগত সুরক্ষামান এবং সামাজিক বীমা ছাড়াই অলিখিত চুক্তিতে কাজ করে। বিশেষ করে, যারা সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর আওতাবহির্ভূত, সেসব আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ একটি বড় বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য শ্রম নিবিড় রপ্তানি খাতের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের উপার্জন রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, কোভিড-১৯ এ ক্ষতিগ্রস্ত অনানুষ্ঠানিক শ্রমিকদের আর্থিক সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা (যেমন: ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ) গ্রহণ; কোভিড-১৯ এবং ভবিষ্যত সংকট সমাধানে সরকারের সুরক্ষা বেষ্টনীর সক্ষমতা বাড়াতে নীতি এবং কর্মসূচির নির্দেশিকা প্রণয়ন এবং শ্রমিকদের সুরক্ষায় শ্রমবিধি এবং মানসমূহ কার্যকর করার জন্য সরকারি খাতের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সামাজিক সুরক্ষাবলয়ের সক্ষমতা বাড়িয়ে বর্তমান কোভিড-১৯ এর অভিঘাত মোকাবিলা এবং জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপর্যয়সহ ভবিষ্যত সংকট প্রশমনে স্তম্ভ ‘খ’ সামাজিক স্থিতিস্থাপকতা বৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে।
স্তম্ভ ‘গ’—পিছিয়ে পড়া/দুস্থ জনগোষ্ঠীর অধিক হারে প্রবেশ নিশ্চিত করতে নীতি ও কর্মসূচি উন্নয়ন:
এতে ডিপিসি-১ এবং ডিপিসি-২ এর অধীন গৃহীত মূলনীতিগুলোর কার্যকর প্রয়োগ কর্মসূচি এবং সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করবে। স্তম্ভ ‘গ’ এর মাধ্যমে কয়েকটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সেগুলো হলো—সরকারি প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের দেশ ত্যাগের আগে এবং ফিরে আসার পর সরকারি সেবাগুলো গ্রহণ সহজীকরণ; যুব ও প্রবাসী শ্রমিকদের প্রাসঙ্গিক ও সমন্বিতদক্ষতা বাড়ানো; মহিলাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো এবং দিবাযত্ন কেন্দ্রের লাইসেন্সিংসহ অন্যান্য সেবাকে একটি আইনি কাঠমোর মধ্যে আনতে হবে। এর আগে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রীর অনুমোদন নিয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে এ কর্মসূচির অর্থায়ন চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দলিলাদির ওপর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নেগোশিয়েশন হয়েছে। নেগোশিয়েশনের পর ঋণচুক্তি স্বাক্ষরের আগে নোগেশিয়েটেড দলিলগুলোর ওপর লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিভাগের ভেটিং নেওয়া হয়েছে।