করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করে রপ্তানি খাত এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। রপ্তানি আয়ে ঘাটতি কিছুটা কমা শুরু করলেও গত ২ মাস ধরে আবার বাড়তে শুরু করেছে। ফলে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে রপ্তানি আয়ে আবার ধাক্কা লেগেছে। এর মধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকার দেশগুলোতে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণে লকডাউনের সীমা বাড়ানো হয়েছে। দেশেও দ্বিতীয় ঢেউয়ে কারণে চলাচলে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এতে আগামীতে রপ্তানি খাতে আবারও বড় ধাক্কা লাগতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উদ্যোক্তারা। মঙ্গলবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্য মতে ২০২০-২১ অর্থবছরে জুলাই থেকে মার্চ এ ৯ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি কোনোটাই অর্জন হয়নি। বরং ঘাটতির মাত্রা আরও বেড়ে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৩ হাজার ২৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার। এর বিপরীতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৮৯৩ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কমেছে ১৩৪ কোটি ৭ লাখ ডলার বা ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছরের একই সময় রপ্তানি আয় হয়েছিল ২ হাজার ৮৯৭ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। সেক্ষেত্রেও গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশমিক ১২ শতাংশ। এদিকে একক মাস হিসাবে মার্চেও রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি। এ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৪৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৩০৭ কোটি ৬০ ডলার। সেক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে ১০ দশমিক ৭৯ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারিতেও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় কম হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে আয় হয়েছিল ৩১৯ কোটি ডলার। এক মাসে আয় কমেছে ১১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সংশ্লিষ্টরা জানান, করোনার প্রভাবে গত বছর বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছিল। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তখন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাকের প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের কার্যাদেশ বাতিল হয়ে যায়। এছাড়া অন্যান্য রপ্তানি খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এমনকি তৈরি পণ্যও বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হয়নি। এসব কারণে তখন রপ্তানি আয় ভয়াবহভাবে কমেছে। গত বছরের এপ্রিলে রপ্তানি আয় কমেছিল ৮৫ শতাংশ। গত অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ঘাটতি হয়েছে প্রায় ২৬ শতাংশ। এর আগের অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি আয় কম হয়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ। স্মরণকালের মধ্যে তখন রপ্তানি আয়ে এত বড় পতন দেখা যায়নি। সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের মধ্যে তৈরি পোশাকের অবদান প্রায় ৮৪ শতাংশ। রপ্তানি আয় তৈরি পোশাক শিল্প খাত নির্ভর বলে এ খাতে আয় সামান্য কমে গেলেই পুরো খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় কমেছে তৈরি পোশাক খাতে। এ সময় তৈরি পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৪৯৫ কোটি ৬ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ২ হাজার ৩৪৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় প্রায় ৬ শতাংশ কমেছে। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে একই সময় আয় হয়েছিল ২ হাজার ৪১০ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। সে ক্ষেত্রে গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে ২ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সূত্র জানায়, রপ্তানি খাতে আরও একটি ধাক্কা এগিয়ে আসছে। এ নিয়ে শঙ্কিত তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, জাপান, ইতালি, কানাডা, স্পেনে লকডাউন চলছে। যে কারণে রপ্তানি কমেছে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পোশাক শিল্পের ওপর। বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সূত্র জানায়, করোনার তৃতীয় ধাক্কায় এ খাতটি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রপ্তানির কার্যাদেশ কমে গেছে। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছু আদেশ স্থগিত হয়েছিল, কিন্তু পরে ক্রেতারা সেগুলো পুনরায় দেন। সেপ্টেম্বরের পর পরিস্থিতি আবার খারাপ হয়ে যায়। করোনার প্রভাবে বিক্রি না হওয়ায় ক্রেতাদের কাছে আগের পণ্য মজুত রয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগামীতে রপ্তানি আদেশ আরও আশঙ্কাজনক হারে কমে যেতে পারে। এদিকে ইপিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়, তৈরি পোশাক ছাড়াও অন্য খাতগুলোতেও রপ্তানি আয় কমেছে। হিমায়িত খাদ্য খাতে চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪২ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৩৬ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। আয় কমেছে ১৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। এছাড়া গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে ৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কৃষি পণ্য রপ্তানিতে আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৭৯ কোটি ২ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৭৪ কোটি ৬৭ লাখ ডলার। কমেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। উৎপাদিত পণ্য খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ২ হাজার ৯০৬ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ২ হাজার ৭৮২ কোটি ৩৮ লাখ ডলার। ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ আয় কমেছে। আলোচ্য সময়ে পাট ও পাটজাত পণ্যের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৮৬ কোটি ১৮ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৯৫ কোটি ৩৫ লাখ ডলার। এ খাতে আয় বেশি হয়েছে ১০ শতাংশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬৭৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার। আয় হয়েছে ৬৮ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। আয় বেশি হয়েছে শূন্য দশিক ৮ শতাংশ। তবে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি কমেছে শূন্য দশিমক ৫৩ শতাংশ। ইপিবির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্ত বলেন, করোনার প্রভাবে গত বছর রপ্তানি আয়ে ধস নেমেছিল। তা আমারা কাটিয়ে উঠার দিকে যাচ্ছিলাম। এখন দেশসহ বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাওয়ার কারণে রপ্তানি আয়ে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় আমরা কাজ করছি। রপ্তানির নতুন বাজার সন্ধান করা হচ্ছে। আশা করি সামনের মাস থেকেইে রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়াবে।