করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে সারাদেশে চলছে সরকারঘোষিত বিধি-নিষেধ। এমন পরিস্থিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা। আবার কেউ কেউ রয়েছেন ছাঁটাইয়ের আতঙ্কে। বিভিন্ন সেক্টরে আর্থিক প্রণোদনাসহ সহায়তার নানা উদ্যোগ থাকলেও এসব শ্রমিকদের জন্য রয়েছে শুধুমাত্র ‘সমন্বয়’ এর উদ্যোগ। জানা গেছে, গত বছরের ২৬ মার্চ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। পরে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাগুলো স্বাস্থ্যবিধির শর্ত মেনে পরিচালনার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশি ক্রেতাদের অনাগ্রহে অনেকটা অচল হয়ে পড়ে অধিকাংশ রফতানিমুখী কারখানা। তবে বছরের শেষ দিকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কিছুটা ছন্দ ফিরলেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে অনেকটা নাজুক অবস্থায় পড়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে বিধায় সংক্রমণ এবং চাকরি হারানো, এই দুই দ্বিমুখী শঙ্কা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এছাড়াও অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে এখনো বেকার রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধ ও ঝুঁকি ভাতাসহ সার্বিক সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা। শিল্প পুলিশের তথ্য মতে, করোনার কারণে দেশের ছয় শিল্প এলাকার সাড়ে ছয় শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গত বছরের মার্চ থেকে চলতি বছরের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও খুলনা এলাকার প্রায় ৮ হাজার কারখানার মধ্যে এই কারখানাগুলো বন্ধ হয়েছে। ফলে অন্তত ২ লাখ শ্রমিক বেকার হয়েছেন। শ্রমিকরা বলছেন, গত ১৩ এপ্রিল করোনা সংক্রমণরোধে সরকারি বিধি-নিষেধ ঘোষণার পর থেকে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে বিধায় সংক্রমণ এবং চাকরি হারানো, এই দুই দ্বিমুখী শঙ্কা নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে তাদের। এছাড়াও অনেক শ্রমিক চাকরি হারিয়ে এখনো বেকার রয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের হয়রানি বন্ধ ও ঝুঁকি ভাতাসহ সার্বিক সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন তারা। এর আগে গত বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণজনিত অর্থনৈতিক সংকট সামলাতে গার্মেন্টসসহ রফতানি খাতের জন্য প্রণোদনা হিসেবে ৫ হাজার কোটি টাকা বিতরণ করে সরকার। এতে শর্ত রাখা হয়, এ টাকা দিয়ে শুধুমাত্র শ্রমিকদের বেতন দিতে হবে। যেসব শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদনের ৮০ শতাংশ রফতানি করে, তারাই দুই শতাংশ হারে সুদের শর্তে এই প্রণোদনার টাকা নেয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন সাপোর্ট টু ন্যাশনাল সোশ্যাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি রিফর্ম ইন বাংলাদেশ প্রোগ্রামের আওতায় রফতানিমুখী তৈরি পোশাক, চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা শিল্পের কর্মহীন শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মাসিক ৩ হাজার টাকা দেয়া হচ্ছে। উপকারভোগী একজন শ্রমিক সর্বোচ্চ তিন মাস আর্থিক সহায়তা পাবেন। শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনাভাইরাসের অন্য সব পেশার মানুষের মতো শ্রমিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আর সেজন্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অন্যান্যা সরকারি সহায়তার তালিকায় শ্রমিকদের যুক্ত করাসহ বিভিন্ন আর্থিক অনুদানে তাদের সম্পৃক্ত করার সমন্বয় করা হচ্ছে। এর বাইরে মন্ত্রণালয়ের জন্য বাড়তি কোনো বরাদ্দ না থাকায় সরাসরি সহায়তা বা অনুদানের সুযোগ নেই। করোনার এমন পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের সহায়তার বিষয়ে কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে শ্রম অধিদফতরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবদুল লতিফ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের শতভাগ উদ্যোগ রয়েছে। সীমিত সম্পদের মধ্যে আমরা যা যা করতে পারি সেটা আমরা করছি, মেইনলি তাদের পাশে দাঁড়ানোটাই আমাদের উদ্দেশ্য। একটা এলাকায় শ্রমিকরা বেকার থাকলে স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ত্রাণ বা যা কিছুই দেয়া হোক সেটা যেন আমাদের শ্রমিকরা পায় সেটি নিয়ে আমাদের অফিসাররা কাজ করছেন। যেমন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশন থেকেও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে। সেই সহযোগিতা যেন আমাদের শ্রমিকরা পেতে পারে সেটা অ্যাড্রেস করা হয়। যারা ভারনারেবল শ্রমিক তাদের আমাদের অফিসাররা চেনেন বা জানেন তাদেরকে সরকারি যেসব সাহায্য সেটা যেভাবেই দেয়া হোক তার আওতায় আনার কাজটি করেন। আমরা সমন্বয় বা ক্যাটালিস্ট হিসাবে কাজ করছি। আমাদের তো নিজস্ব ভিন্ন কোনো ত্রাণ বা অনুদান নেই যেটা আমরা তাদের দিতে পারি।’ শ্রমিকদের সহায়তার বিষয়ে কোনো উদ্যোগের বিষয়ে অবগত আছেন কিনা জানতে চাইলে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজেট তো শুধু মালিকদের দেয়া হয়। মালিকরা বাজেট নেয়, শ্রমিকরা কাজ করলে পয়সা পায় আর না করলে পায় না। আমরা চাচ্ছি শ্রমিকরা যদি এ ধরনের লকডাউন বা মহামারির সময়ে কাজও না করে সে সময়ে যেন সাধারণ শ্রমজীবী মানুষকে সহায়তা দেয়া হয়। মালিকরা শুধু বলেন প্রণোদনা দেন, গত বছরও তো ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনার মধ্যে ৮০ শতাংশ গার্মেন্টস শিল্প পেলো। তারপর ওয়ার্কাররা কাজ না করলে বেতন দেয়নি, এই টাকা নিয়ে তো তাদেরই লাভ হয়েছে।’ বিভিন্ন জায়গায় সরকারি সহায়তা ও ত্রাণের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শ্রমিকদের ত্রাণ দিয়েছে কিনা বলতে পারছি না। আমি দেখিনি ওয়ার্কারদের এমন কোনো সহায়তা দিতে। আমি শুধু দেখেছি মালিকদের টাকা দিয়েছে।’ শ্রমিকদের সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব কে, এম, আব্দুস সালাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শ্রমিকদের নিয়ে আমরা ব্যাপকভাবে চিন্তা করছি। সকল সেক্টরের শ্রমজীবী মানুষকে নিয়ে আমরা ভাবছি। আমাদের বিশেষ পরিকল্পনা হলো সরকারের যে প্রোগ্রামগুলো আছে সেই প্রোগ্রামের সঙ্গে শ্রমিকদের একটা কানেক্টিভিটি আমরা তৈরি করে দেয়ার চেষ্টা করছি। প্রথমত টিসিবি কম দামে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করে, এর সঙ্গে আমরা একটা কানেক্টিভিটি তৈরি করে দিয়েছি যে টিসিবির ট্রাকগুলো আমাদের শ্রমঘণ এলাকায় গিয়ে কম দামে বিক্রি করছে। এটা তাদের জন্য একটা সাপোর্ট।’ ‘দ্বিতীয়ত সকল জেলা প্রশাসক বিশেষ করে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, খুলনা ও ঢাকার ডিসির সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকার যে বিভিন্নভাবে ত্রাণ দিচ্ছে তার মধ্যে এই শ্রমজীবী মানুষদের যেন যুক্ত করা হয়, সেটা প্রায়োরিটি দেয়ার জন্য ডিসিদের সঙ্গে কথা বলেছি। সার্বিকভাবে সরকারের যে সেক্টরগুলো রয়েছে এর সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষকে আরও কিভাবে ইন্ট্রিগ্রেট করা যায় সেটিতে আমরা ফার্স্ট প্রায়োরিটি দিচ্ছি। এছাড়াও আমাদের সোশ্যাল যে সেফটিনেস প্রোগ্রাম রয়েছে সেটা নিয়ে আরও কিভাবে মানুষকে সাপোর্ট দেয়া যায় সেটা নিয়েও আমরা ভাবছি।’ এদিকে কর্মস্থলে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত, যাতায়াত ও ঝুঁকি ভাতা প্রদান এবং কর্মী ছাঁটাই বন্ধসহ ৬ দফা দাবি জানিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মান্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে পোশাক শ্রমিকদের সংগঠন ‘সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন’। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে- স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের আনা-নেয়া নিশ্চিত করা বা অতিরিক্ত যাতায়াত ভাতা ঘোষণা করা। কর্মস্থলে শ্রমিকদের প্রবেশ-বের হওয়ার সময় কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি ও কাজের স্থানে ৩ ফুট দূরত্ব কার্যকর করা। কঠোর ‘লকডাউন’ চলাকালে যেসব শ্রমিক ঝুঁকি নিয়ে কারখানায় কাজ করছেন তাদের ঝুঁকি ভাতা দেয়া। পোশাক শ্রমিকদের জন্য করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা প্রদান। এই মুহূর্তে কোনো কারখানা শ্রমিক ছাঁটাই না করা। যেসব কারখানা মার্চ মাসের মজুরি প্রদান করেননি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে শ্রমিকদের মজুরি প্রদানের নির্দেশ দেয়া। সব শ্রমিকের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ ও নির্দেশনা প্রদান করা।