সারা বিশ্বে নতুন নতুন বাজার তৈরির পাশাপাশি রপ্তানি আয় বাড়াতে আরও ১০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি ও জায়ান্ট গ্রুপের কর্ণধার ফারুক হাসান। তার মতে, এটি দেয়া হলে প্রতি বছরই দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বাড়তি রপ্তানি আয় যোগ করতে পারবো। ফলে একদিকে দেশে নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে, অন্যদিকে নতুন বিনিয়োগও বাড়বে। ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট এবং করোনা মহামারিতে দেশের বৃহৎ তৈরি পোশাক খাতের সার্বিক অবস্থা, আগামীর চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্বব্যাপী নন-কটন বেইজড অর্থাৎ কৃত্রিম তন্তু বা ম্যানমেড ফাইবার দিয়ে তৈরি পোশাকের চাহিদা এখন তুঙ্গে। পোশাক খাতের বৈশ্বিক বাজারের ৭৪ শতাংশ এখন ম্যানমেডের দখলে। অথচ বাংলাদেশ এই খাত থেকে আয় করে মাত্র ৩০-৩২ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী কৃত্রিম সুতার বিপ্লব ঘটলেও তুলনামূলক বেশি বিনিয়োগ, কারিগরি সক্ষমতার অভাব ও মালিকদের উদাসীনতায় এই খাতে তেমন ভালো করতে পারছে না বাংলাদেশ।এজন্য প্রতিযোগিতায়ও পিছিয়ে পড়ছেন রপ্তানিকারকরা। এই অবস্থায় বিশ্ববাজারের পোশাক রপ্তানিতে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করতে ম্যানমেড কাপড়ে তৈরি পোশাককেই একমাত্র বিকল্প দেখছেন কারখানা মালিকরা। এজন্য এই খাতে রপ্তানিতে ১০ শতাংশ প্রণোদনা চাইছে বিজিএমইএ। এমনটি হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, এর মানে এই নয় যে আমরা নিজেদের স্বার্থেই কেবল প্রণোদনা চাচ্ছি। আমরা হিসাব করে দেখেছি, সরকার থেকে এই সুবিধাটা পেলে আগামী অর্থবছরে ২ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব। এতে একদিকে যেমন নতুন কর্মসংস্থান হবে, অন্যদিকে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়বে। প্রণোদনা চাওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই খাতের ক্রেতাদের অন্য দেশ থেকে বাগিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর খাতটি প্রতিষ্ঠিত হলে প্রণোদনার আর প্রয়োজন পড়বে না। বিজিএমইএ’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে ম্যানমেড ফাইবারের মোট বাজার ৮ বিলিয়ন ডলারের। এই খাতে যদি ১০ শতাংশ প্রণোদনা দেয়া হয় তাহলে বছরে সরকারকে গুনতে হবে ৮০০ মিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিনিময়ে দেশে বাড়তি রপ্তানি আয় আসবে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ফারুক হাসান বলেন, রপ্তানিতে নন-কটন পণ্যের বিপুল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কারণ সারা দুনিয়ায় এখন নন-কটন পোশাকের ব্যবহার বেশি হচ্ছে। বিশ্বে বর্তমানে মোট চাহিদার ৭৫ শতাংশ পোশাকই নন-কটনের তৈরি। কিন্তু আমরা উল্টো পথে হাঁটছি। আমাদের রপ্তানি পোশাকের ৭৫ শতাংশ কটন বেইজড অর্থাৎ প্রাকৃতিক তুলার তৈরি পোশাক। মাত্র ২৫ শতাংশ রপ্তানি করছি নন-কটন পণ্য। তার মানে, এখানে নন-কটনের একটি বড় সম্ভাবনা আছে। তাই এখন কটন পণ্যের রপ্তানি অব্যাহত রেখে নন-কটনেও জোর দিতে হবে। যেহেতু এ পণ্যের চাহিদা আছে তাই আমরা মনে করছি এখনই প্রস্তুতি নিতে পারলে খুব সহজে এ বাজারে প্রবেশ করতে পারবো। ফারুক হাসান বলেন, এক্ষেত্রে সরকার একটা সমাধানে যেতে পারে। প্রথম তিন বছর ম্যানমেডের পোশাক রপ্তানি করলেই প্রণোদনা এমন নিয়ম চালু করতে পারে। এরপর দুই বছরের জন্য শর্ত দিতে পারে যে অবশ্যই দেশের টেক্সটাইল মিলে কাপড় বুনন হতে হবে। পাঁচ বছর পরে কেবলমাত্র দেশে উৎপাদিত সুতা ও কাপড় দিয়ে প্রস্তুত করা পণ্যকেই প্রণোদনার উপযুক্ত করা যেতে পারে। এভাবে একটি নীতিমালা করে প্রণোদনা ঘোষণা করতে হবে। তখন টেক্সটাইল খাতের উদ্যোক্তারা স্থানীয় বাজার ধরতে নতুন কারখানা স্থাপন করতে চাইবেন। এভাবে নিট কাপড়ের মতো আমাদের ম্যানমেডের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজও পাঁচ বছর পরে শক্তিশালী হবে। ফারুক হাসান বলেন, পুরো বিশ্বই এখন করোনার প্রভাবে বিপর্যস্ত। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। করোনার কারণে আমাদের বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। প্রথমত, করোনার কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। ফলে আমরা ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কারখানা পরিচালনা করতে পারছি না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা চালাতে গিয়ে খরচ বেশি হচ্ছে। এ ছাড়া কনটেইনার ও শিপিং কস্ট বেড়েছে। মহামারির মধ্যেও তুলা, সুতা ও কাপড়ের দাম বাড়তি। ফলে আমাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে। কিন্তু বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়ায়নি। এসব বাস্তব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হচ্ছে। তবে সব চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সম্ভাবনাও থাকে। বর্তমান সময়টি যেমন বড় চ্যালেঞ্জের তেমনি বেশকিছু সম্ভাবনার পথও উন্মুক্ত হয়েছে। পণ্য রপ্তানির নতুন বাজার সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা আছে। এখন দরকার সরকারের নীতি-সহায়তা, পাশাপাশি বায়ারদের (ক্রেতা) সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি করা। তাহলে রপ্তানি বাড়িয়ে দেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করতে পারবো। করোনা ক্ষতি কাটিয়ে কবে নাগাদ এ শিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? জবাবে ফারুক হাসান বলেন, এখন আমরা পোশাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ। কিন্তু আমাদের মার্কেট শেয়ার মাত্র ৬.৮ শতাংশ। অর্থাৎ এ খাতে আমাদের আরও অনেক উন্নতির সুযোগ আছে। বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক রপ্তানিতে বাঙালির পুরো বছরের ক্ষতির পুনরুদ্ধার চলতি বছরের অক্টোবরের মধ্যে হতে পারে। তিনি বলেন, আমরা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ আশাবাদী কেননা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশির ভাগ মানুষ ইতিমধ্যে টিকা গ্রহণ সম্পন্ন করেছেন এবং ক্রমাগত স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম, পোশাকের চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। গ্রাহকগণ ধীরে ধীরে মার্কেটে গিয়ে পোশাক ক্রয় শুরু করেছেন। একইভাবে ইউরোপের খুচরা বিক্রেতারা ও দামি দামি ব্র্যান্ডগুলো তাদের দোকানগুলো পুনরায় চালু করতে শুরু করেছেন, যার জন্য বাংলাদেশের তৈরি পোশাক আইটেমগুলোরও চাহিদা বাড়ছে, বলে তিনি জানান।