করোনা মহামারীর মধ্যে রপ্তানি বাণিজ্যে আঘাত এসেছিল। শুরুতে এ আঘাত এতটাই প্রবল ছিল যে, পোশাক শিল্প অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রথমে করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই স্বল্প পরিসরে বিপণি কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া, টিকা উদ্ভাবন ও মানুষের শরীরে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোতে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হয়। এ সময় মানুষের কেনাকাটাও বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকেও। সর্বশেষ গত নভেম্বর মাসের রপ্তানি চিত্রেও এর প্রভাব পড়েছে। চলতি বছরের শেষের দিকে এসে রপ্তানিতে লক্ষ্য পূরণ না হলেও ঘুরে দাঁড়ানোর পরিবেশ তৈরি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে এমন চিত্র মিলেছে। তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জুলাই-মে ১১ মাসে মোট রপ্তানি হয়েছে ৩৫ দশমিক বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি। তবে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫ দশমকি ৭৬ শতাংশ কম। চলতি বছরের ১১ মাসের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩৭ দশমিক ৩৩০ বিলিয়ন ডলার। আর পুরো বছরের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৪১ বিলিয়ন ডলার। গত অর্থবছরে দেশে-বিদেশে করোনা মহামারীর সর্বোচ্চ আঘাতে রপ্তানিতে বড় ধরনের ধস নামে। যদিও গত বছরের মে মাস থেকে প্রতি দিনই একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ায়। ২০১৯-২০ পৃষ্ঠা ১১ কলাম ৪ রপ্তানি বাণিজ্যে সুবাতাস অর্থবছর শেষে রপ্তানির পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ দশমিক ৬৭৪ বিলিয়ন ডলার। যা আগের বছরের চেয়ে ১৭ শতাংশ কম। এবং আগের বছরগুলোর প্রবৃদ্ধির হার যোগ করলে ঘাটতির হার ছিল প্রায় ২০ শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি ছিল ৪০ দশমিক ৫৩৫ মিলিয়ন ডলার। দেশের মোট রপ্তানিতে তৈরি পোশাক রপ্তানিই ৮৫ শতাংশের উপরে। এক সময়ের প্রধান রপ্তানি পণ্য পাট ও পাটজাত রপ্তানি নেমে গেছে দুই নম্বরে এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির প্রায় এক-চর্তুথাংশে। ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমলে যেমন রপ্তানি আয় কমে, একই সাথে কর্মসংস্থান প্রভাব ফেলে, দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ, গ্রামীণ উন্নয়ন ও নারী ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের আঘাত পড়ে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে জুলাই-মে ১১ মাসে ৩০ দশমিক ৭৬০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ২৮ দশমিক ৫৬১ বিলিয়ন ডলার। যা মোট রপ্তানি আয়ের ৯২ ভাগ তৈরি পোশাক। ১১ মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানির এ পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১১ শতাংশ বেশি। রপ্তানি আয়ের এ চিত্র ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশ^জুড়ে করোনা দ্বিতীয় ঢেউ, তৃতীয় ঢেউ লাগলেও এরই মধ্যে তৈরি পোশাক রপ্তানি হবে। পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে যে সব দেশে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়, সে সব দেশ টিকা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। করোনা আক্রান্ত হলেও তারা পোশাকের মতো নিত্যপণ্য কেনাকাটা করবে। এতে বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশে কমবে না। তৈরি পোশাক পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সিনিয়র সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, ৩১ মে পর্যন্ত রপ্তানি আয়ের যে চিত্র তা আমাদের আশাবাদী করেছে। তবে তৈরি পোশাক রপ্তানি পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়েছে, এমন বলা যাবে না, ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে শেষ মাস জুন শেষে যে রপ্তানি আয় দাঁড়াবে তখনো করোনামুক্ত স্বাভাবিক সময় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ের চেয়ে দেড় থেকে দুই বিলিয়ন কম থাকবে। বিশ্বজুড়ে করোনার যে অভিঘাত লেগেছিল, তৈরি পোশাক রপ্তানি যে আঘাত লেগেছিল তা থেকে পুরোপুরি রিকোভারি হয়ে স্বাভাবিক অবস্থাতে ফিরে যেতে আমাদের আগামী অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তারপর রপ্তানি আয়ে নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। রপ্তানি আয়ের স্বপ্নের পাশাপাশি অনিশ্চয়তাও কিছুটা রয়েছে। টিকা না দিতে পারলে সম্ভাবনা অনিশ্চয়তায় পরিণত হতে পারে বলে মনে করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, যে সব দেশে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় সে সব দেশে টিকা দেওয়া ইতোমধ্যে শেষের দিকে। তারা মনে করছে টিকা দিতে পারলে করোনা থেকে মুক্ত হওয়া যাবে। আগামীতে ওই সব দেশ তৈরি পোশাক আমদানি করার সময় তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক দেশে টিকা দেওয়া সম্পন্ন হয়েছে-কিনা তা দেখবে। সেক্ষেত্রে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সমস্যা তৈরি হবে। এ জন্য দ্রুত টিকা দেওয়া সম্পন্ন করতে হবে। তৈরি পোশাক বাদে অন্য প্রধান পণ্য পাট ও পাটজাত পণ্য, হিমায়িত মৎস্য ও কৃষি পণ্য রপ্তানিতে যথাক্রমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ৩৩ শতাংশ, এক শতাংশ এবং ১৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। গত বছরের করোনার মধ্যেও এ সব পণ্য রপ্তানি ছিল ইতিবাচক। এখন তৈরি পোশাক রপ্তানি ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরো রপ্তানি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে যাবে।